হিটশকের প্রভাবে ৩২৮ কোটি টাকার বোরো ধানের ক্ষতি
সারাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হিটশকের (গরম বাতাসের প্রবাহ) কারণে ৩২৮ কোটি টাকার বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে। দেশের মোট ৩৬টি জেলার বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে বলে কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
গত ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় বেশকিছু অঞ্চলের ওপর দিয়ে গরম বাতাস বয়ে গেছে। এই বাতাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ধানের। অনেক অঞ্চলের ধান গাছগুলো ফ্লাওয়ারিং স্টেজ বা মিল্কিং স্টেজে (ধানে চাল গঠনের পর্যায়ে) থাকায় গরম বাতাসে এগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এসব ধান গাছ থেকে আর চাল পাওয়া যাবে না।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, মোট ৩৬ টি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই হিটশকে ২১২৯২ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। যাতে সম্ভাব্য ফলন পাওয়া যেত প্রায় ১ লাখ টন। ধানের পাশাপাশি ভুট্টা, সবজি, চীনাবাদাম, সূর্যমুখী ও কলার ফলন নষ্ট হয়েছে। সব মিলে টাকার অংকে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩৪ কোটি টাকার বেশি।
এতে করে মোট উৎপাদন কম হবে ৯৯৯৬৮ মে. টন যার মধ্যে ৯৫৯৩৪ টন বোরো।
বোরো ধানের মোট আক্রান্ত জমির পরিমাণ ৬৮১২৩ হেক্টর। যার মধ্যে ১০২৯৮ হেক্টর জমির ধান পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। বাকিটুকুতে আংশিক ক্ষতি হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বোরো ধানের। এরপরই ভুট্টা। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রায় ৪ কোটি টাকার ভুট্টা নষ্ট হয়েছে।
সরেজমিন কয়েকটি অঞ্চল ঘুরে এসে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা দেয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। কি ধরণের প্রণোদনা দেয়া হবে সে বিষয়ে এখনো কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় নি।
মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণ ক্ষতির বিষয়ে হিসেবনিকেশ করলেও সমস্যা অন্য জায়গায়। যাদের বোরো ধানের আংশিক ক্ষতি হয়েছে এবং এই ক্ষতির পরিমাণ যাদের জমির অর্ধেক বা এর বেশি তারা আর বোরোতে সেচ দিচ্ছে না বলে জানা গেছে। কারণ কৃষকরা বলছেন ফলন কম হলেও খরচ কমবে না। এ কারণে তারা আর এগুলো চাষ করতে চাচ্ছেন না।
গাজীপুর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নাজমুল বারী টিবিএসকে বলেন, যাদের ধান আংশিক নষ্ট হয়েছে তারা আর সেগুলো চাষ করতে চাচ্ছে না। এটা একটা বড় সমস্যা। যেটুকুই হোক ফলন যাতে নষ্ট না হয় বিষয়ে তাদেরকে সচেতন করা জরুরী।
তিনি বলেন, আংশিক আক্রান্ত জমিগুলোতে প্রচুর পরিমাণে পানি দেওয়ার পাশাপাশি পানি ধরে রাখারও ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে বাকি ফলনও ক্ষতির মুখে পড়বে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আক্রান্ত জেলাগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পরিমাণ তিন লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে বোরো চাষী রয়েছেন ৩০৩৬২০ জন এবং ৩৪২৫ জন রয়েছেন ভুট্টাচাষী, ৩৭০ জন সবজি চাষী, ১৮০ জন চিনাবাদাম, ১৫০ জন সূর্যমুখী এবং ২২৫৫ জন রয়েছেন কলাবাগানের মালিক।
এদিকে মাত্রাতিরিক্ত গরম বাতাস আর ঝড়ের কারণে বগুড়ায় অন্তত ৪৯৪ বিঘা জমির ধানে পরাগায়নে সমস্যা হয়েছে। এতে এসব জমির ধানে অন্তত ৪৫ শতাংশ চিটা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষকদের অন্তত ৩১ লাখ টাকার লোকসানে পড়তে হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলার ১২টি উপজেলায় বোরো ধানের চাষ হয়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৬১৫ হেক্টর জমি। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ লক্ষ্য ৬২ হাজার মেট্রিক টন। এবার বোরা ধান রোপন করার পর থেকে আবহাওয়া ভালো ছিল। কিন্তু গত ৪ এপ্রিল বিকেলে কালবৈশাখী ঝড়ের সাথে গরম বাতাস হওয়ার কারণে ধানের রেনুর পরাগায়নে সমস্যা হয়েছে। কৃষি দপ্তরের ৯ এপ্রিলের হিসাবে জেলায় প্রায় ৮০ হেক্টর জমির অন্তত ৪৫ শতাংশ ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এর মধ্যে সারিয়াকান্দি উপজেলায় ৫০ হেক্টর, ধুনটে ৭৫ হেক্টর, সোনাতলায় ৪৫ বিঘার ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাকী ধানের ক্ষতি হয়েছে নন্দীগ্রাম ও গাবতলী উপজেলায়।
তবে এই দুই উপজেলায় ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক কম।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বোরো ধানের শীষ বের হওয়ার আগে তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থাকতে হয়। তাহলে পরাগায়ন ভালো হয়। ধানের ফলনও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু গত ৪ এপ্রিলের ঝড়ে বৃষ্টির চেয়ে বাতাসের পরিমাণ বেশি ছিল। বাতাস ছিল ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের চেয়ে বেশি। এ কারণে ধানের রেনুর পরাগায়নে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। পরাগায়ন না ঘটে শীষে এখন ধানগুলো একদম সাদা অথবা কালো হয়ে গেছে। এসব ধানের মধ্যে কোনো দানা নেই। সবগুলো চিটায় পরিণত হয়েছে। কৃষি কর্মকর্তাদের ভাষ্য, গরম বাতাসে ক্ষতির ফলে ধানের ফলন অন্তত ৪৫ শতাংশ কমে যাবে।
সাধারণত বোরো ধান প্রতি বিঘায় গড়ে ২০ মণ করে ফলন হয়। গরম বাতাস ও ঝড়ের কারণে সেই ফলন এবার ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি বিঘায় ১০ থেকে ১১ মণ করে হবে। ৫৪ শতাংশ চিটা হলে বিঘাপ্রতি ৯ মণ করে ধানের উৎপাদন কমে যাবে। এ হিসাবে জেলায় ৪৯৪ বিঘায় মোট ৪ হাজার ৪৪৬ মণ ধান কম উৎপাদন হবে। মৌসুমে এই ধান বিক্রি হয় সাধারণত গড়ে ৭০০ টাকা মণ করে। এ হিসেবে এই ধানের বাজারমূল্য দাঁড়ায় ৩১ লাখ ১২ হাজার ২২০ টাকা। এই ক্ষতি হবে পুরোটা কৃষকের।
সারিকান্দির হাটফুলবাড়ি এলাকার ৬ বিঘা জমিতে ২৮ জাতের ধান চাষ করেছেন সাজু প্রামানিক। গরম ঝড়ো হাওয়ার প্রভাব পড়েছে তার জমিতেও। জানান, 'এ বছর ধানের উঠতি সময়ে আবহাওয়া অনেক ভালো ছিল। আশা করেছিলাম ভালো ফলন পাব। কিন্তু ক'দিন আগের ঝড় সর্বনাশ করে দিয়ে গেলো। এখন ধানের শীষগুলো সাদা হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে অর্ধেক ফলনও পাব না।'
একই এলাকায় চার বিঘা জমি বর্গা নিয়ে বোরো ধান চাষ করেছেন মো. ফিরোজ মিয়া। তিনি বলেন, 'আজকে সকালে (৯ এপ্রিল) জমিতে ধান শীষ সবগুলো কালো। শীষে কোনো ধান নেই। সবগুলো চিটা। এবার যে কীভাবে সংসার চলবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছি।'
পৌনে তিন বিঘা জমির ধান একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানান হাটফুলবাড়ি এলাকার হবিবর রহমান। তিনি বলেন, 'ঝড়ের পর জমিতে ১০ আনা ধানে কোনো দানা নেই। শীষ যেগুলো বের হচ্ছে সেগুলোও মরা। ধান থেকে এবার খড় ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না। আমার ৬০ বছরের জীবনে এমন ক্ষতি দেখি নি।'
আরেক চাষী আবজাল মোল্লা। এক বিঘা জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেছেন তিনি। জানালেন, সম্প্রতি গরম বাতাসের ঝড় আর বালু হাওয়ার কারণে সব শেষ হয়ে গেছে। ঝড়ের দিনে পরাগায়নের জন্য যে রেনু বের হয়েছিল বা ধানের দুধ তৈরি হয়েছিল সেগুলোই নষ্ট হয়ে গেছে। অর্ধেক ধান ঘরে তোলা গেলেও আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করব।
জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল হালিম বলেন, 'এটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বেশ কয়েক বছর পর এমন অবস্থার কবলে পড়েছে কৃষি অঞ্চল। ৪ এপ্রিলের যেসব রেনু বের হয়েছিল তা থেকে ধান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সবগুলো চিটা হবে। এমনকি পরে যেগুলো রেনু বের হবে সেগুলোতে চিটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ হিসেবে এই ঝড়ের কারণে উপজেলায় প্রায় ৩৫০ বিঘা জমিতে প্রায় ৪৫ শতাংশ ধান কম হবে'।
তিনি আরও বলেন, 'প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ থেকে বাঁচাতে আমাদের তেমন করণীয় নেই। তবে ধানের জমিতে এখন পানি রাখতে হবে। তাহলে চিটা কিছুটা কমতে পারে'।
ধুনট উপজেলার কুড়িগাতি এলাকার কৃষক আরিফুল ইসলাম বলেন, এবার তাদের জমির ধান অধিকাংশ চিটা হয়ে গেছে। এতে লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন ব্যয় তোলাই কঠিন হয়ে পড়েছে। আর মাত্র ২০-২২ দিন বাদেই ধান কাটা শুরু হবে অথচ এই সময় এমন ঘটনা ঘটল।
ধুনট উপজেলায় গরম বাতাসের কারণে ৭৫ বিঘা জমির ধান ৫০ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুশিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, গত ৪ এপ্রিলে ঝড়ের সময় বাতাসের তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির উপরে থাকার কারণে ধানের পরাগায়নে সমস্যা হয়েছে। মাঠ ঘুরে দেখা গেছে উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে ৫০ শতাংশ চিটা হবে।
সোনাতলা উপজেলায় গরম বাতাসে অন্তত ৪৫ বিঘা ধান ক্ষতি হয়েছে বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ আহমেদ। তিনি বলেন, তার উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত জমির ধানে ৪৫ শতাংশের বেশি চিটা হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা দুলাল হোসেন বলেন, 'প্রাকৃতিক দুর্যোগে কারও হাত নেই। এই ক্ষতির পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। আরও বাড়তে পারে। কারণ সবগুলো জমির ধানের শীষ এখনো বের হওয়া শেষ হয়নি'।