সংকটে আশুগঞ্জের সম্ভাবনাময় তুষের জ্বালানী ব্যবসা
- আশুগঞ্জ থেকে প্রতি মাসে ৫ কোটি টাকার লাকড়ি বাজারজাত হচ্ছে।
- ধানের হাটে বেচাকেনা কম হওয়ায় চালকলগুলোতে তুষ হচ্ছে কম।
- সংকটের ফলে তুষের দাম বাড়ায় লাকড়ির উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
- অধিকাংশ লাকড়ি কারখানা মালিক পুঁজি সংকটে আছেন।
দেশের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ধানের হাট বসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার মেঘনা নদীর তীরে। আর এই হাটকে ঘিরে প্রায় ২৫ বছর আগে সূচনা হয় তুষের জ্বালানী ব্যবসার। আশুগঞ্জের জ্বালানী কারখানাগুলো থেকে প্রতি মাসে ৫ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের তুষের জ্বালানী (স্থানীয়ভাবে এগুলোকে বলে লাকড়ি) বাজারজাত হচ্ছে। তবে নানা সংকটে সংকুচিত হয়ে পড়ছে সম্ভাবনাময় এই জ্বালানী ব্যবসা। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ৩০-৪০টি কারখানা। চালু থাকা অধিকাংশ কারখানা মালিক পুঁজি সংকটে আছেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেঘনা নদীর ভিওসি ঘাটে বসা ধানের হাটকে পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ধানের মোকাম ধরা হয়। আশুগঞ্জ উপজেলার চালকল মালিকরাই এ হাটের মূল ক্রেতা। আর এই চালকলগুলোকে কেন্দ্র করে আশুগঞ্জে গড়ে উঠে তুষের জ্বালানী তৈরির কারখানা। চালকগুলোতে ধান ভাঙানোর পর যে তুষ তৈরি হয়, সেগুলো লাকড়ি কারখানার মালিকরা কিনে নেন।
তুষের তৈরি লাকড়ি দিয়ে রান্নায় কোনো ধোঁয়া হয়না। এটি গ্যাস ও কয়লার বিকল্প জ্বালানি হিসেবেই এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। মূলত নতুন করে গ্যাস সংযোগ প্রদান বন্ধ থাকায় বাসা-বাড়িসহ সবখানেই তুষের লাকড়ির ব্যবহার বাড়ছে। এছাড়া গ্যাসের সংকটের কারণে বিভিন্ন কলকারখানাতেও তুষের লাকড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক বছর আগেও আশুগঞ্জে ৭০-৮০টি তুষের লাকড়ি তৈরির কারখানা চালু ছিল। তবে করোনাসহ বিভিন্ন সংকটের কারণে অর্ধেকেরও বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কেবল ৩০-৩৫টি কারখানা চালু আছে। একেকটি কারখানায় ৫-৬ জন করে শ্রমিক কাজ করেন। কারখানাগুলোর একেকটিতে প্রতিদিন গড়ে দেড়শ মণ জ্বালানী তৈরি হয়।
ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত হয় আশুগঞ্জের এই জ্বালানী। বর্তমানে প্রতি মণ জ্বালানী-লাকড়ি পাইকারদের কাছে বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকা দরে। মূলত ধানের মৌসুমকেই লাকড়ি ব্যবসার মৌসুম ধরা হয়। কারণ তখন কম দামে চাহিদা মতো তুষ পাওয়া যায়।
তবে এখন উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কারখানা মালিকরা এ ব্যবসা থেকে কাঙ্খিত মুনাফা পাচ্ছেন না। এছাড়া গতবছর করোনাকালে ঠিকমতো ব্যবসা করতে না পেরে অধিকাংশ কারখানা মালিক এখন পুঁজি সংকটে আছেন। ফলে কারখানাগুলোতে চাহিদা মতো লাকড়ি তৈরি করা যাচ্ছে না।
ভারত থেকে চাল আমদানির ফলে আশুগঞ্জের ধানের হাটে ধান বেচাকেনা কমে গেছে। এতে করে লাকড়ি কারখানাগুলোর চাহিদা মতো তুষ মিলছে না চালকলগুলোতে। ফলে সংকটের কারণে তুষের দাম বেড়ে গেছে। এতে করে লাকড়ির উৎপাদন খরচও বেড়েছে।
বর্তমানে চালকল থেকে ৬ টাকা কেজি দরে তুষ কিনতে হচ্ছে কারখানা মালিকদের। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে পরিবহন খরচ। তবে সংকটের আগে প্রতি কেজি তুষ ৩-৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতো। এই সংকটের মাঝেও বিদ্যুতের বাণিজ্যিক লাইনের বিল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কারখানা মালিকদের। একেকটি কারখানায় মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে প্রায় লাখ টাকার কাছাকাছি।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এক মণ লাকড়ি তৈরিতে ৪৩ কেজি তুষের প্রয়োজন হয়। তুষের পরিবহন খরচ, শ্রমিকদের মজুরি ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে এখন খুব বেশি মুনাফা হচ্ছে না লাকড়ি ব্যবসা থেকে। প্রতি মণ লাকড়ি বিক্রি করে ১০-১৫ টাকা লাভ হচ্ছে মাত্র। এখন চালকলগুলোতে তুষ কম হওয়ায় চাহিদা মেটাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাইরে থেকেও তুষ আনা হচ্ছে। কিন্তু এতে করে জ্বালানীর উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
আশুগঞ্জের সোনারামপুর এলাকার সুবেদার জ্বালানী মিলের স্বত্বাধিকারী সায়েদুর রহমান রনি বলেন, 'আগে এ ব্যবসা থেকে সব খরচ মিটিয়ে বছরে ৮-৯ লাখ টাকা লাভ হতো। কিন্তু গতবছর করোনার কারণে ব্যবসা করতে পারিনি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ভারত থেকে চাল আমদানির ফলে চালকল মালিকরা কম ধান কিনছেন। এতে করে তুষের সংকট তৈরি হয়েছে। শ্রমিকদের মজুরি ও বিদ্যুৎ বিলসহ আনুষাঙ্গিক খরচ মিটিয়ে খুব একটা লাভ হচ্ছে না ব্যবসায়। শুধুমাত্র ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় কোনোরকমে কারখানা চালু রেখেছি'।
আশুগঞ্জের কামাউরা এলাকার শিউলি কয়েল লাকড়ি মিলের স্বত্বাধিকারী সেলিম ভূঁইয়া বলেন, 'আগে প্রতিদিন দুই-তিনশ মণ লাকড়ি তৈরি হতো আমার কারখানায়। কিন্তু এখন তুষের সংকটের কারণে এক-দেড়শ মণ তৈরি হচ্ছে। তুষের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা মতো লাকড়ি তৈরি করা যাচ্ছে না। ভারতীয় চাল আমদানির ফলে চালকলগুলোতে তুষের সংকট তৈরি হয়েছে। এ সংকট যদি আরও প্রকট হয়- তাহলে মিল বন্ধ রাখতে হবে'।
এ ব্যাপারে আশুগঞ্জ লাকড়ি মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বুলু হায়দার বলেন, 'গ্যাস ও কয়লার বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন কলকারখানা ও বাসাবাড়িতে আমাদের লাকড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এ ব্যবসার দিকে সরকারের কোনো নজর নেই। ব্যাংক থেকেও আমাদের ঋণ দেওয়া হয় না। অথচ মাসে ৫-৬ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে এ ব্যবসায়'।
'আমাদের অধিকাংশ কারখানা মালিক শুধুমাত্র পুঁজির অভাবে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন নতুন করে তুষের সংকট তৈরি হয়েছে। একের পর এক সংকটের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে লাকড়ি ব্যবসা। যদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পাওয়া যায়, তাহলেই কেবল লাকড়ি ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যাবে,' উল্লেখ করেন বুলু হায়দার।