সংকটের মুখে হাকালুকি হাওরের মৌসুমী ব্যবসা ‘বাথান’
দেশের বৃহৎ হাওর হাকালুকি। ছোট-বড় ২৩৮টি বিল, ১০টি নদী নিয়ে প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর আয়তনের এ হাওর বর্ষায় নদী-খাল প্লাবিত হয়ে ২৩ হাজার হেক্টরের বিশাল জলাশয়ে পরিণত হয়। হাওরের ৮০ ভাগ মৌলভীবাজারে আর ২০ ভাগ সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। বর্ষার সাগরের মত দিগন্তহীন এই হাওর গ্রীষ্মে হয় শুকনো পতিত জমির মত।
এই হাকালুকি হাওরের অন্যতম ঐতিহ্য 'বাথান' (গবাদিপশুর রাখালী) ব্যবসা। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী 'বাথান' ব্যবসা থেকে আগ্রহ হারাচ্ছেন এ পেশায় জড়িতরা। গো-খাদ্য সংকট, বাথানে পর্যাপ্ত গবাদিপশু না পাওয়া, চোরের উপদ্রব এবং সংগৃহীত দুধ বাজারজাতকরণে সমস্যাসহ নানা প্রতিকূলতার জন্য হাওরের এক সময়ের পুঁজিহীন লাভজনক আদি এ ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকেই। গত দুই দশকে হাকালুকিতে কমেছে অর্ধেকেরও বেশি 'বাথান'।
সরেজমিনে হাকালুকিতে ঘুরে জানা যায়, শুষ্ক মৌসুমে হাওরের জনপ্রিয় ও পুঁজিহীন কায়িক শ্রমে লাভজনক রাখালী ব্যবসা 'বাথান'। প্রতি বছরের শুকনো মৌসুমে হাকালুকি তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকার গৃহস্থরা তাদের গবাদি পশুর খাবার সংকটে পড়েন। তখন হাওরে গো-খাদ্যের উর্বর ভূমি থাকায় সেখানকার 'বাথানে' গরু, মহিষ পাঠিয়ে দেন মালিকেরা। এজন্য বাথান থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় গরু-মহিষের মালিকরা খুশি হয়ে পাঁচশ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত দেন। আর দুধেল গাভীর জন্য মালিকদের টাকা দিতে হয়না। প্রতিটি ছোট বাথানে ২শ থেকে ৪শ এবং বড় বাথানে ৫শ থেকে ৮শ গরু-মহিষ রাখা হতো। অক্টোবর-নভেম্বর মাস থেকে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত বাথানে থাকা গরু-মহিষ থেকে দুধ ও গোবর সংগ্রহ করে বিক্রি করতেন ব্যবসায়ীরা। ছোট বাথানে ৭-৮জন, বড় বাথানে ১০ থেকে ১২ জন লোক মাসিক পারিশ্রমিকে কাজ করতেন।
প্রতিদিন সকালে বাথানের কাজে নিয়োজিত রাখালরা গাভী থেকে দুধ দোহনের পর গরু-মহিষগুলো সারাদিন বিস্তীর্ণ হাওরে চরানো শেষে সন্ধ্যা এলে আবার হাওরের বাথানের নির্দিষ্ট স্থানে এনে গবাদি পশুগুলো বেঁধে রাখেন। হাওরে রাত কাটানো কষ্টকর হলেও নিজেরা তাবু টাঙানো ঘরে রান্না, খাওয়া দাওয়া ও রাত যাপন করেন। এতে এই মৌসুমে বেকার থাকা হাওরের জীবিকা নির্ভর মানুষের কর্মসংস্থান হয়। প্রতিটি বাথানে থাকা গাভীগুলো থেকে দৈনিক ৭০-৮০ লিটার থেকে দেড়শত লিটার পর্যন্ত সংগৃহীত দুধ আশেপাশের এলাকার চাহিদা মিটিয়ে ছানা তৈরীর জন্য বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করা হতো। এভাবেই হাওরের ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় এ ব্যবসা চলে আসছিল।
কিন্তু দিন দিন হাওরের পরিবেশ সংকটাপন্ন হয়ে গো-খাদ্যের অভাব, চোরের উপদ্রব, বাথানে প্রয়োজনীয় গবাদি পশু না পাওয়া, দুধ বাজারজাতকরণে সমস্যা, অসুস্থ গবাদিপশুর চিকিৎসার জন্য সময় মতো ভেটেরিনারি ডাক্তার না পাওয়াসহ নানা প্রতিকূলতা ও সংকটে জনপ্রিয় 'বাথান' ব্যবসা অনেকটা অলাভজনক হয়ে পড়েছে। এতে এ পেশায় জড়িতরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। হাওরের কালাপানি, ফুটবিল, টেকুনা, চকিয়া, নাগুয়া বিল এলাকায় ১৫টির বেশি ছোট-বড় 'বাথান' রয়েছে।
হাওরের বাথানের গবাদিপশু চরানোয় ব্যস্ত শ্রমিক (রাখাল) কয়েছ মিয়া, তানভীর, মাজিদ আলী, ছমর মিয়ার সাথে আলাপকালে বলেন, তারা একেকজন বর্ষাকালে নৌকায় বালু-ইট পরিবহন, কেউ আবার মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। আশ্বিন-কার্তিক মাস থেকে চৈত্র-বৈশাখ পর্যন্ত শুধু বিল ছাড়া হাওরে পানি থাকে না। তখন রোজগারের জন্য বাথানের গরু-মহিষ হাওরে চরানো, পরিচর্যা, দুধ দোহানো ও রাতে পাহারা দিতে হয়। এজন্য তারা কাজ অনুযায়ী মাসিক কেউ ১০ হাজার, কেউ ৬ হাজার পারিশ্রমিক পান। তারা বলেন, বিল ও জলাশয়ের তীরে প্রচুর ঘাস থাকে। কিন্তু বিলের ইজারাদারদের ও ক্ষেতের মালিকদের নিষেধের কারণে হাওরে আগের মতো গরু-মহিষ চরানো যায়না। এছাড়া বিল ও জলাশয়ের পাশে পাখি শিকারীদের ফেলে রাখা বিষটোপের জন্য গরু-মহিষকে চরিয়ে ঘাস খাওয়াতে পারিনা। ঘাস কেটে এনে খাওয়াতে হয়। এত গরু-মহিষকে ঘাস কেটে খাওয়ানো খুব কষ্টসাধ্য। কালাপানি, টেকুনা ও নাগুয়া বিল এলাকায় থাকা বাথানের মালিক অশোক মিয়া, হীরা মিয়া, লয়েছ আহমদ ও
তুহিন আলী জানান, কুলাউড়া জুড়ীর বিভিন্ন গ্রামের লোকজন তাদের গরু মহিষ বাথানে দিয়ে যান। আগের তুলনায় গত ৭-৮ বছর ধরে এখন বাথানের সংখ্যা কমেছে ও গরু-মহিষের সংখ্যাও অনেক কমেছে। আগে হাওরের কুলাউড়া ও জুড়ী অংশে ৬০-৭০টি বাথান ছিলো। আগে একেকটি বাথানের জন্য ৩ শত থেকে ৬-৭ শত গরু-মহিষ পাওয়া যেতো এবং প্রতিদিন ৬০-৭০ লিটার থেকে একশ লিটারের বেশি দুধ সংগ্রহ করা যেতো।
এখন বড় একেকটি বাথানে খুব বেশি হলে ৩ থেকে ৪শ টি গরু-মহিষ রয়েছে ও প্রতিদিন খুব বেশি হলে ২৫ থেকে ৩০ লিটার দুধ পাওয়া যায়। তারা আরো বলেন, অনেক বাথানে ৫-৬জন মিলে গরু-মহিষ এনে নিজেরাই এসব দেখাশুনা করতেন। আবার কেউ কেউ বেতন দিয়ে ৭-৮ জন লোক রেখে বাথানের গরু-মহিষ দেখাশুনা করতেন। বছরের ৫ থেকে ৬ মাস এ ব্যবসায় ভালোই লাভ হতো। হাওরে এখন গো-খাদ্যের অভাব, অধিক খরা, যখন তখন বজ্রবৃষ্টিতে খোলা আকাশের নীচে থাকা গরু-মহিষগুলো অসুস্থ হয়ে যায়। গরু-মহিষ অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য ডাক্তার পাওয়া যায় না। এছাড়া বাথান কমে যাওয়ায় রাতে চোরের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। এতে মালিকেরা তাদের গরু-মহিষ আর বাথানে দিতে চান না। আগে একটি বাথানে ৫-৬ জন রাখাল কাজ করতেন কিন্তু এখন গরু-মহিষ কমে যাওয়ায় ৩-৪ জনের বেতন চালানো অনেক কষ্টসাধ্য। তাই অনেকে বাথান ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে কুলাউড়া উপজেলা প্রাণী সম্পদ কার্যালয়ের কর্মকর্তার ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে থাকা ডা. গোলাম মোহাম্মদ মেহেদী বলেন, 'আগে হাওর ও আশেপাশের এলাকায় গবাদিপশু অসুস্থ হলে ভেটেরিনারি রায়হান আহমদ চিকিৎসা দিতেন। উনি মারা যাওয়ার পর থেকে পদটি শূন্য। লোকবল সংকট ও যাতায়াত কষ্টসাধ্য হওয়ায় যখন তখন হাওরে গিয়ে বাথানের অসুস্থ গবাদি পশুর চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। তবুও আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি। হাওরে গো-খাদ্য সংকট, যেখানে সেখানে শিকারীদের ফেলে রাখা বিষটোপ খেয়ে ও শেড (ছাউনি) ছাড়া খোলা আকাশের নিচে থাকায় গবাদিপশু অসুস্থ হয়ে যায়। অনেক মালিক এখন আর তাদের গরু-মহিষ বাথানে দিতে চান না। এজন্য হয়তো বাথান থেকে আগ্রহ কমে যাচ্ছে অনেকের'।