লকডাউনে চট্টগ্রামে নিত্যপণ্যের সরবরাহ কমেছে ৭০ ভাগ
চট্টগ্রামের সবজি ও নিত্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার রেয়াজুদ্দিন বাজার। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সবজি, ডিম, কাঁচামরিচসহ সব ধরনের নিত্যপণ্য আসে এই বাজারে। গত ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউন শুরু হওয়ায় রেয়াজুদ্দিন বাজারে সবজি ও অন্যান্য পণ্যের সরবরাহ কমে গেছে প্রায় ৭০ ভাগ। ক্রেতা না থাকায় কমে গেছে পণ্যের দামও।
রেয়াজুদ্দিন বাজারসহ চট্টগ্রামের নিত্যপণ্যের সকল পাইকারি বাজারের চিত্র একই। পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আসছে না সবজি, মাছসহ বিভিন্ন পণ্য।
রেয়াজুদ্দিন বাজার বণিক কল্যান সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি এস এম এয়াকুব বলেন, 'রেয়াজুদ্দিন বাজারের সবজিসহ অন্যান্য পণ্যের সরবরাহ ৭০ ভাগ কমে গেছে। লকডাউনের কারণে অনেকেই শহর ছেড়েছেন। যারা আছেন তারাও বাসা থেকে তেমন বের হচ্ছেন না। ফলে পণ্যের চাহিদা অনেক কমে গেছে। তাছাড়া ডাউন ট্রিপে ভাড়া না থাকায় চট্টগ্রামে পণ্য নিয়ে আসতে রাজী হচ্ছে না ট্রাক চালকরা। এতে স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়েছে ভাড়া। এই অবস্থায় পাইকারি ব্যবসায়ীরা পণ্য এনে বিক্রি হওয়ার নিশ্চয়তা পাচ্ছে না'।
রেয়াজুদ্দিন বাজারের ডিমের আড়তদার আবদুল মতিন বলেন, 'প্রতিদিন টাঙ্গাইল, সরিষাবাড়ি, তারাকান্দি সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় ১০ লাখ পিস ডিম আসে এই বাজারে। করোনার লকডাউন শুরু হওয়ার পর এই পরিমান দাঁড়িয়েছে ২ লাখে। বিক্রি না হওয়ায় পাইকারিতে ডজন প্রতি দাম কমেছে ১০ টাকা'।
সবজি সরবরাহ করতে না পেরে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। গাড়ী সংকটের কারণে পাইকার আসতে না পারায় স্থানীয়ভাবে স্বল্পমূল্যে সবজি বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। আবার সবজির দামের সাথে গাড়ি ভাড়া সমন্বয় না হওয়ায় ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে অনেক কৃষকের সবজি।
মিরসরাইয়ের সবজি চাষী নুরে সোবহান মিন্টু বলেন, 'বাঁধাকপি ১০০ পিস পাইকারী বিক্রি হচ্ছে ৭ শ থেকে ১ হাাজার টাকায়। মিরসরাই থেকে সবজির পাইকারী বাজার সীতাকুণ্ডের শুকলালহাট কিংবা বড়দারোগারহাট নিয়ে যাওয়ার যেই খরচ তা সবজি বিক্রি করে উঠে না আসায় ক্ষেতেই রয়ে গেছে বাঁধাকপি। এছাড়া বরবটির ও কাঙ্খিত দাম পাচ্ছিনা। লকডাউন পরিস্থিতিতে সবজি নিয়ে আমরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি'।
এদিকে সবজির পাশাপাশি মাছের সরবরাহও কমেছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন আড়তে। নগরীর ফিশারী ঘাট, পাহাড়তলী মৎস আড়তে আসছে না চট্টগ্রামের বাইরের অঞ্চলের মাছ। লকডাউন শুরু হওয়ার পর শুধুমাত্র চট্টগ্রামের আশপাশের উপজেলা মিরসরাই, সীতাকুণ্ড, পটিয়সহ কয়েকটি উপজেলা থেকে মাছের সরবরাহ আসছে। এসব মাছ চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন বাজারে খুচরা বিক্রেতারা নিয়ে যেতো। এখন খুচরা বিক্রেতার পরিমানও কমে গেছে।
পাহাড়তলী রেলওয়ে বাজার মৎস আড়তদার সমবায় সমিতির অর্থ সম্পাদক ফরহাদ আহমেদ শিবলু বলেন, 'আমার আড়তে প্রতিদিন সকাল এবং বিকেলে গড়ে প্রায় ২০ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হতো। এখন বিকাল সময়ের বেচাকেনা বন্ধ। সকালের বিক্রিও কমে গেছে প্রায় ৬০ ভাগ। একই অবস্থা পাহাড়তলী বাজারের ৩২টি আড়তের'।
এদিকে সামুদ্রিক মাছের বড় বাজার চট্টগ্রামের ফিশারী ঘাট থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫০ থেকে ৬০ টন সামুদ্রিক ও মিঠা পানির মাছ সরবরাহ হয়। লকডাউনের কারণে বর্তমানে এই সরবরাহ কমেছে অর্ধেকেরও বেশি।
চট্টগ্রাম জেলার ৭৫ ভাগ মিষ্টি পানির মাছের যোগান হয় মিরসরাইয়ের মুহুরী প্রজেক্ট এলাকার মৎস্য প্রকল্প থেকে। মুহুরী প্রকল্পে ছোট বড় প্রায় ২ হাজার মৎস্যচাষী আছে। প্রতিদিন চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় প্রায় দেড়শ ট্রাক মাছ সরবরাহ হয় মুহুরী প্রজেক্ট থেকে। করোনায় মাছের দাম এবং চাহিদা কমে যাওয়ায় এই সংখ্যা নেমে এসেছে একশ'র নিচে। অন্যদিকে মাছের খাদ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় দুই দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মৎস্যচাষীরা।
মুহুরী প্রজেক্টের মৎস্যচাষী কামরুল হোসেন বলেন, 'লকডাউনের আগে রুই মাছ প্রতি মন বিক্রি হতো গড়ে প্রায় ১০ হাজার টাকা। বর্তমানে সেটি বিক্রি হচ্ছে ৮ হাজার টাকায়। অন্যান্য মাছের দামও মনপ্রতি দাম কমেছে প্রায় ১ হাজার টাকা। অনেক মৎস্যচাষী প্রকল্পের মাছ বিক্রি করে খাদ্য ক্রয় করে। এই অবস্থায় কম দামে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন মৎস্যচাষীরা'।
মুহুরী প্রজেক্টের আরেকমৎস্যচাষী এম এ হায়দার বলেন, 'মাছের অন্তত ২০ আইটেম খাদ্যের দাম হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। টন প্রতি খাদ্যের দাম বেড়েছে ৫ থেকে ১০ হাজার। করোনার লকডাউন শুরু হওয়ায় মাছের সরবরাহ কমে গেছে। এই অবস্থায় মৎস্যচাষীরা উভয় দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে'।
এদিকে লকডাউনের কারণে বন্ধ আছে আকাশ পথে সবজি রপ্তানি। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে সবজি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এসআর এন্টারপ্রাইজের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, 'এই মৌসুমে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এবং খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি থেকে বরবটি, চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে কাকরোল বিদেশে রপ্তানি হতো। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায় যাওয়ায় সবজি রপ্তানিও বন্ধ রয়েছে'।