'মাল্টিকালার' মুরগি: ফার্ম থেকে টেবিলে
–মৃত্যুহার ২ শতাংশের নিচে, যেখানে সোনালিতে ১০-১৫ শতাংশ
–এক কেজি ওজন পেতে সময় লাগে ৫৬ দিন, সোনালিতে দরকার ৭০ দিনের বেশি
–নতুন জাতে মেডিসিনে ৫০ শতাংশ খরচ কম
–সোনালির চেয়ে নতুন জাতের মুরগির উৎপাদনে ২০ শতাংশ খরচ কম লাগছে
–বাণিজ্যিকভাবে বেসরকারি খাতে প্রথম বাচ্চা উৎপাদন করছে
–প্রতিদিন ১০-১৫ হাজার বাচ্চা উৎপাদন করছে আফতাব
–এক হাজার বাচ্চা পালনে লাভ হচ্ছে ৪৫-৬০ হাজার টাকা
–গায়ের রং দেশি মুরগির মতই
–লাভ বেশি হওয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে খামারিদের মধ্যে
খুব বেশিদিন হয়নি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পোলট্রি কৃষক আবুল কালাম একটি নতুন জাতের মুরগি সম্পর্কে জেনেছেন। অনেকটা কৌতূহলী হয়েই তিনি এক দিন বয়সী এক ব্যাচ মুরগির বাচ্চা কিনে আনেন এবং জেলার নবীনগর এলাকায় নিজের খামারে সেগুলো লালন-পালন করতে থাকেন।
লোকমুখে তিনি শুনেছিলেন এই নতুন জাতের মুরগির মধ্যে দেশীয় কিছু বৈশিষ্ট্য আছে।
মুরগিগুলো লালন-পালন করার পর আবুল কালাম যে ফলাফল পেলেন তা তাকে মুগ্ধ করলো। তিনি দেখলেন, এই জাতের মুরগিগুলো সহজেই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে না এবং সাধারণ মুরগির চাইতে তাদের জন্য তুলনামূলক কম ওষুধপত্রের প্রয়োজন হচ্ছে। তাছাড়া মুরগিগুলো খুব তাড়াতাড়ি বেড়েও উঠেছে।
নতুন জাতের এই মুরগির মাংসে এক ধরনের গাঢ় স্বাদ পাওয়া যায়; এটি কম ফ্যাটযুক্ত এবং দেশী মুরগির মতো শক্ত ধরনের। অন্যদিকে, ফার্মের সাধারণ মুরগির মাংস হয় বেশ মাংসল ও নরম।
কালাম তার মুরগিগুলো প্রতি কেজি ২৫০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। অন্যদিকে, বাজারে জনপ্রিয় সোনালি মুরগির দাম বর্তমানে ১৮০ টাকা কেজি।
কালাম জানান, তিনি সাধারণ মুরগির পাশাপাশি এই নতুন জাতের মুরগিও তার খামারে পালন করছেন।
২০১৮ সালে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) উদ্ভাবিত এই নতুন জাতের মুরগি এই মুহূর্তে দেশের খামারিদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করেছে।
ইনস্টিটিউট এটিকে 'মাল্টিকালার টেবিল চিকেন' বা এমটিসি নামে আখ্যা দিয়েছে। এতদিন সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়ায় পরীক্ষামূলকভাবে এটি উৎপাদন করা হয়েছে। এবার শুরু হয়েছে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন।
গবেষণা ইনস্টিটিউট(বিএলআরআই) বলছে, দেশি মুরগির স্বাদ এবং বৈশিষ্ট্য থাকায় এর ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে।
ইনস্টিটিউট আরও জানায়, মাল্টিকালার চিকেন জাতের মুরগির মৃত্যুহার মাত্র ২ থেকে ৫ শতাংশ। নতুন এ জাতটির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি, যে কারণে ৫০ শতাংশ মেডিসিনের পেছনে অর্ধেক খরচ কমে গেছে।
বিএলআরআই মুরগির এই জাতটির সম্প্রসারণে আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী, বিএলআরআই আফতাবকে এর ব্রিড দিচ্ছে।
বর্তমানে আফতাব বহুমুখী ফার্মস প্রতিদিন এ জাতের ১০ থেকে ১৫ হাজার মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করছে। তারা এক দিনের বাচ্চা উৎপাদন করে সারাদেশে তাদের ডিলারদের মাধ্যমে বিক্রি করছে।
এর পাশাপাশি এ বছর থেকেই আরও চারটি খামারে এর উৎপাদন শুরু করেছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
বিএলআরআই এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ রাকিবুল হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এতদিন দেশি মুরগির বিকল্প একটি জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা ছিল। তবে আমরা শুধু জাত উদ্ভাবনেই সীমাবদ্ধ নেই, বাণিজ্যিকীকরণের প্রথম ধাপ পার করেছি। ইতোমধ্যেই প্রাইভেট সেক্টরের মাধ্যমে সারাদেশে খামারি পর্যায়ে বিক্রি শুরু হয়েছে।"
তবে এই মুহূর্তে ঠিক কী পরিমাণ খামারি সারাদেশে এই মুরগি পালন করছে তার নির্দিষ্ট হিসাব বিএলআরআইয়ের কাছে নেই।
বিএলআরআইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সোনালি বা পাকিস্তানি কক জাতের মুরগিগুলোতে দেশি জাতের কোন সংমিশ্রণ নেই। কিন্তু মাল্টিকালার টেবিল চিকেন জাতটি জাপানি একটি জাতের সঙ্গে দেশি মুরগির ব্রিডের সমন্বয়ে উদ্ভাবন করা হয়েছে। সে কারণে এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি।
সোনালির জায়গা নেবে এমসিটিসি
এই মুহূর্তে বাজারে সোনালি মুরগির চাহিদা ও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। কিন্তু পশুসম্পদ গবেষক ও ব্রিডাররা বলছেন, দেশের কৃষকদের মধ্যে মাল্টিকালার টেবিল চিকেন নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হওয়ায় এই জাতটির সোনালির জায়গা দখল করতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
শীতের মৌসুমে বাংলাদেশের মানুষের দৈনিক ৩৫০০ টন মুরগি প্রয়োজন হয়। দেশে এই মুহূর্তে দৈনিক ৩০ লাখ পিস এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চা উৎপাদিত হচ্ছে।
পোলট্রি খামারিরা জানান, সোনালি জাতের একটি মুরগির ওজন ১ কেজি হতে ৭০ দিনের বেশি সময় লাগে। এক্ষেত্রে এমসিটিসিতে লাগে ৫৬ দিন। সোনালি জাতের মৃত্যুহার ১০-১৫ শতাংশ। ক্ষেত্রবিশেষে এটি ২০ শতাংশও দেখা গেছে। তবে বিএলআরআই এর গবেষণা বলছে, দুয়েকটি ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া এমসিটিসি জাতের মুরগির মৃত্যুহার ২ শতাংশের নীচে।
এ বিষয়ে আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার মাহমুদ-উল-আলম টিবিএসকে বলেন, এ মুরগি পালনে সোনালি মুরগির চেয়ে কমপক্ষে ২০ শতাংশ খরচ কম পড়ে। ফলে কম সময়ে এতে লাভও বেশি।
এদিকে বিএলআরআইয়ের গবেষণা বলছে, নতুন জাতের ১ হাজার মুরগি পালন করে খামাড়িরা ৪৫-৬০ হাজার টাকা আয় করতে পারে। সে হিসেবে এক বছরে ১ হাজার মুরগির চারটি ব্যাচ পালন করে ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। যেখানে সোনালিতে এই লাভ অনেক কম।
গবেষণা তথ্যে আরও দেখা গেছে, এমসিটিসি জাতের মুরগিগুলোর মাংসের স্বাদ ও পালকের রং দেশি মুরগির ন্যায় মিশ্র বর্ণের হওয়ায় খামারিরা প্রচলিত সোনালী বা অন্যান্য মুরগির চেয়ে বেশি বাজার মূল্য পাচ্ছে। বর্তমানে প্রতি কেজি মুরগি খামারিরা ২৫০ টাকার বেশি দামে বিক্রি করছে বলেও জানা গেছে।
গবেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তালিকার প্রথম দিকে। প্রতিনিয়ত পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব কম-বেশি সব খাতের উপরেই দৃশ্যমান। অন্যান্য প্রাণীকুলের তুলনায় পোল্ট্রি প্রজাতি পরিবেশের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল।
অন্যদিকে, দেশের ব্রয়লার-লেয়ারের সব জাতই বিদেশ থেকে আমদানিকৃত হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে সেগুলোর কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সেই দিক বিবেচনায় বিএলআরআই উদ্ভাবিত মাংস উৎপাদনকারী এমসিটিসি জাতটি পরিবর্তনশীল আবহাওয়া উপযোগী এবং এর উৎপাদনের উপর কোন ক্ষতিকর প্রভাব নেই।
ড. মো. রাকিবুল হাসান জানান, বাণিজ্যিক খামার পর্যায়ে মূল্যায়ন ও সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড কোম্পানির সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং যৌথ গবেষণা চলমান রয়েছে। প্যারেন্ট লাইনের ডিম উৎপাদন, ডিমের আকার, অভিযোজন ক্ষমতা, রোগবালাইসহ সামগ্রিক বিষয়বিএলআরআইয়ের গাইড লাইন ও কারিগরি পরামর্শে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিনিয়তই জাতটির মান উন্নয়নে গবেষণা চলমান রয়েছে।