মহামারিতে বগুড়ার আবাসন খাতের ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে
তিনটি বিভাগীয় শহরের বাইরে দেশের মধ্যে আবাসন খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বগুড়া ধুকছে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে। বগুড়ায় আবাসন শিল্প খাতে ব্যবসায়ীরা অন্তত ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বছর ধরে লোকসানের মুখে রয়েছেন।
ব্যবসারীরা বলছেন, সারা দেশে আবাসন খাতে গুরুত্বের বিবেচনায় চার নম্বর অবস্থানে রয়েছে বগুড়া। কেন্দ্রীয় অবস্থানের কারণে এক নম্বর স্থানে রয়েছে ঢাকা। পরের অবস্থান বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামের। তৃতীয় স্থানে আছে সিলেট। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসা শুরুর ২০ বছরের মধ্যে বগুড়া দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরকে পেছনে ফেলে আবাসন খাত উর্দ্ধমুখী গতিতেই ছিল। কিন্তু গত এক বছরে করোনভাইরাস মহামারির প্রভাবে সেই গতি ক্রমাগত কমেছে । কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও শঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বগুড়ার আবাসন ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে বগুড়ার বিখ্যাত ব্যবসায়ী ময়েজ মিয়ার হাত ধরে শুরু হয় আবাসান ব্যবসা। তিনি শহরের সরকারি আজিজুল হক কলেজ এলাকায় রেডিলাইট নামের একটি ভবন নির্মাণের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেন। এরপর দু'একজন করে অনেকে এই ব্যবসার দিকে ঝুঁকতে থাকেন।
কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ভৌগোলিক কারণে বগুড়া রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের 'প্রাণ কেন্দ্র'; কৃষি, শিল্প যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানা ও উৎপাদিত পণ্য দেশের বাইরে রপ্তানিতে অন্যতম বগুড়া। একারণে এখানে মানুষের বসবাসের চাহিদাও ব্যপক। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই বগুড়ায় আবাসন ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকে।
বগুড়ায় প্রায় ২০ বছর ধরে আবাসন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন কমফোর্ট হাউজিং লিমিটেডের মালিক মো. জুলকার আলী খান চৌধুন ওরফে ম্যাকলিন।
করোনাকালে আবাসন ব্যবসার পরিস্থিতি সম্পর্কে ম্যাকলিন বলেন, 'গত এক বছর ধরে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য আমরা আবাসন ব্যবসায় রয়েছি। ক্রেতারা অনেক সময় কিস্তি দিতে হিমশিম খাচ্ছে। আমরাও ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে হাপিয়ে উঠেছি,'
'করোনার আগে বগুড়ায় আবাসন ব্যবসায় অনেক বিপ্লব ঘটানো গেছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের দুর্বল করে দিয়েছে মহামারি। বগুড়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করে ঢাকা থেকে অনেক নামীদামি ব্যবসায়ী বগুড়ায় এসেছিল; কিন্তু তারা করোনার কারণে ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেছে।'
'বগুড়া রিয়েল এস্টেট অ্যাসোসিয়েশনের সূত্রে জানা গেছে, বগুড়ায় অন্তত ৫০ জন ব্যবসায়ী আবাসন খাতের সঙ্গে যুক্ত। তবে সংগঠনটির সদস্য এখন ৩১ জন। সব ব্যবসায়ী মিলে বগুড়ায় অন্তত ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।
বগুড়ায় আবাসন খাতে অন্তত ৬০০ জন শ্রমিক কাজ করেন। শুধু ব্যবসায়ী নয়, করোনাভাইরাস শ্রমিকদের জীবন যাপনেও প্রভাব ফেলেছে।
বগুড়ার রাজাবাজারে শাহ্ সুলতান প্রোপার্টিজ কয়েক বছর ধরে আবাসন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এর স্বত্তাধিকারী মো. সোহানুর রহমান সোহাগের আবাসন খাতে তার প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে।
তিনি বলেন, 'গত এক বছরে করোনার কারণে তার অন্তত ২০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। আরও লোকসান হবে জেনেও ব্যবসায় টিকে থাকতে হচ্ছে। কারণ, উপায় নেই। কোনো ব্যবসা মাঝপথে রেখে যাওয়া যায় না।'
মহামারি আরও দীর্ঘস্থায়ী হলে ব্যাংক ঋণে জর্জরিত হবেন বলে জানান তিনি।
বগুড়া শহরের নওয়াবাড়ি সড়কের রানার প্লাজার স্বত্তাধিকারী মো. সাইরুল ইসলাম বলেন, 'করোনাকালে অন্যদের মতো্ যুদ্ধ করে ব্যবসায় টিকে থাকতে হচ্ছে। করোনাকে পুঁজি করে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ছে হু হু করে,'
'এর মধ্যে এক মাসের ব্যবধানে সিমেন্টে দাম প্রতি বস্তায় বৃদ্ধি পেয়েছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা করে। রডের দামও কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকার উপরে। প্লাস্টির পাইপ প্রতি ফিটে দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা করে। অথচ এই সময়ে ফ্ল্যাটের দাম বাড়েনি এক পয়সাও,' যোগ করেন তিনি।
বগুড়া রিয়েল এস্টেট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাইরুল প্রায় শতকোটি টাকা বিনিয়োগ করে ২০১০ সালে বগুড়ায় আবাসন ব্যবসা শুরু করেন।
বগুড়া রিয়েল এস্টেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনোয়ারুল করিম দুলাল বলেন, 'আমরা কয়েকজন যৌথভাবে আবাসন ব্যবসায় প্রায় ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। গত এক বছর ধরে আমাদের ব্যবসায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনাভাইরাস। মহামারির কারণে আমরা ঠিকমতো ফ্ল্যাট বিক্রি করতে পারছি না,'
'করোনাভাইরাস মহামারি আমাদের ব্যবসায়িকভাবে এক বছরে ৪০ শতাংশ ক্ষতির মুখে দাঁড় করিয়েছে। গত রজমানেও করোনার কারণে লকডাউন দেওয়া হয়েছিল। এবারও দেওয়া হবে হয়তো। কিন্তু এই সময়ে আবাসন ব্যবসা থেকে বড় আয় আসে আমাদের। করোনায় আমাদের বিপর্যস্ত করে ফেলছে,'
আনোয়ারুল করিম আরও বলেন, আমরা বগুড়ার আবাসন ব্যবসায়ীরা জিডিপির ক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখছি। আমাদের এখানে কাজ শিখে প্রায় ১২০ জন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু ভবনের নকশার ক্ষেত্রে একই দেশে দু'ধরনের নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে।
বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. জিয়াউল হক বলেন, করোনার কারণে অন্য ব্যবসায়ীরাও মোটামুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর বহুতল ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে। প্রতি দুই মাস পর পর এই কমিটির সভা হয়। সেখানে যাচাই-বাছাই শেষে সব ফাইল ছেড়ে দেওয়া। তবে আমাদের আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।