ভূমি অধিগ্রহণেই আটকে আছে জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল
ধীর গতিতে এগুচ্ছে জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ। ২০১৭ সালে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অতিরিক্ত সময় বাড়ানোর পরও এখনও ভূমি অধিগ্রহণেই আটকে আছে প্রকল্পটি।
৩৩০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে । বাস্তবায়ন কাজ শেষ করার লক্ষ্য ধরা হয় ২ বছর। নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় পর দুই দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। গত সপ্তাহে প্রকল্পটির মেয়াদ তৃতীয় বারের মতো আরও এক বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
এর আগে গত নভেম্বরে প্রকল্পটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রকল্পের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। আইএমইডির প্রতিবেদনে প্রকল্পটি বিলম্ব হওয়ার বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করে মেয়াদ আবারও এক বছর বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়।
এর ভিত্তিতে পরিকল্পনা কমিশন কাজ শেষ করতে আরও এক বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে।
আইএমইডি বলছে, প্রকল্পের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হচ্ছে না। প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয়েছে ৪২.৭০ শতাংশ। ভূমি অধিগ্রহণ ও অন্যান্য কাজের অগ্রগতি ২১.৪৬ শতাংশ।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, চুক্তি অনুযায়ী মাটি ভরাটের কাজ ৯৮ শতাংশ শেষ হয়েছে। এমনভাবে মাটি ভরাট করা হয়েছে যাতে অঞ্চলটি বন্যার পানি থেকে রক্ষা পায়। তবে বরাদ্দ না থাকায় আরও উচ্চতা বাড়াতে হলে প্রকল্প সংশোধন করতে হবে।
প্রকল্পের মাটি ভরাটের উচ্চতা জামালপুর-টাঙ্গাইল হাইওয়ের উচ্চতা থেকে চার-পাঁচ ফুট নিচু। এলাকাটি বন্যাপ্রবণ হওয়ায় প্রায় প্রতিবছরই বন্যার পানি মহাসড়কের উচ্চতাকে অতিক্রম করে।
প্রকল্প এলাকার উচ্চতা হাইওয়ের উচ্চতার সমান করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক আরও জানান, প্রকল্প এলাকার প্রায় ২০ একর জুড়ে একটি গ্রাম থাকায় জমি অধিগ্রহণ করতে দেরি হচ্ছে। এই ২০ একর যায়গা অধিগ্রহণে আরও প্রায় ৬০ কোটি টাকা প্রয়োজন, যা প্রকল্পের প্রস্তাবে নেই। এ অবস্থায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খাস জমির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
জামালপুর জেলার সদর উপজেলায় , দিগপাইত নামক স্থানে রঘুনাথপুর, দিঘুলী, সুলতাননগর জোয়ানের পাড়া, হরিদ্রাহাটা, ছোনটিয়া, গাজ্জাইল মৌজায় মোট ৪৩৬ দশমিক ৭ একর জায়গায় এ অর্থনৈতিক অঞ্চলটি স্থাপন করা হচ্ছে। মোট ভূমির ৯২ দশমিক ৯৫ একর সরকারি খাস জমি এবং ৩৪৪ একর অধিগ্রহণ করতে হবে। এ পর্যন্ত ২৩৫ একর জমি কর্তৃপক্ষ বুঝে পেয়েছে । বাকি ১১৬ একর ভূমি এখনও দখল পাওয়া যায়নি।
জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভূমি বরাদ্দের লক্ষ্যে প্রসপেকটাস বিতরণ করা হচ্ছে। বিদেশি এবং অন্যান্য বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করার লক্ষ্যে প্রকল্পে কাজ দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন বলে মনে করছে আইএমইডি।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের পর ৯ মাস ২০ দিন পর প্রশাসনিক অনুমোদন পায়। এ কারণে প্রকল্পের কার্যক্রম দেরিতে শুরু হয়।
আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকল্প এলাকায় সময়মতো মাটি ভরাট না হওয়ায় মূল কাজ গুলো বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়েছে। মাটি ভরাটের কাজ ২০১৮ সালের অক্টোবরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। ৬ দফায় এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। পরে ভরাটের কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। কিন্তু এর পর ভরাটের কাজ ২ শতাংশ বাকি ছিল।
প্রকল্পে পূর্ত কাজ করার ক্ষেত্রে নকশা , ডিজাইন ও প্রাক্কলন বিলম্ব হওয়ায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন নির্ধারিত সময়ে সমাপ্ত করা যায়নি বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় ২টি ডরমেটরি, সীমানা প্রাচীর, ডিআরএস স্টেশন, পানি সরবরাহ, সংযোগ সড়কের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ড্রেনেজ, ওয়াকওয়ে, সড়ক বাতি, সেন্ট্রি বক্স, পানি সরবরাহ লাইন, প্রয়োজনীয় সংখ্যাক নলকূপ স্থাপনের নকশা দেরি এসেছে। অনেক কাজের নকশা এখনও পাওয়া যায়নি। এসব কাজে সময়মতো দরপত্র আহ্বান করা যায়নি বলে কাজ বিলম্ব হচ্ছে।
আইএমইডি সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়, মাটি ভরাট না হওয়ায় পূর্ত কাজের সিডিউলও পিছিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ সাব-বাউন্ডারি দেয়ালের অধিকাংশ, সংযোগ সড়কসহ অনেক পূর্ত কাজ শুরু করা যায়নি। মাটির ভরাটের কাজ শেষ না হওয়ায় এসব শুরু করা যাচ্ছে না।
প্রকল্পেটির ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) পর্যালোচনায় দেখা যায়, পণ্য ক্রয়ে ৩টি এবং পূর্ত কাজের জন্য ৭টি প্যাকেজ রয়েছে। ভূমি উন্নয়নের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০১৭ সালের মার্চে। দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নির্বাচন এবং চুক্তি করা পর্যন্ত আট মাস সময়ে লেগেছে।
ভূমি উন্নয়নে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ১৬ মাস সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এসময়ে মাত্র ২৪ শতাংশ কাজ শেষ করতে পেরেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ প্যাকেজের ৬ বারে ২১ মাস সময় বাড়ানো হয়েছে।
প্রকল্পের অন্যান্য প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। তবে ৩ টি ভবনের বৈদ্যুতিক ফিটিং, গেট নির্মাণ, পানি সরবরাহ, ড্রেনেজ, ট্রিটমেন্ট প্লান্ট এবং ওয়াক ওয়ের ব্যয় প্রাক্কলন এখনও করা হয়নি।
এদিকে প্রকল্পের উত্তর-পশ্চিম পাশে বিলের খাস জমি ড্রেজিংয় এলাকাবাসী বাঁধা দিয়েছে। প্রায়ই এলাকার লোকজন এসে ড্রেজিংয়ের জন্য স্থাপিত পাইপ খুলে নিয়ে যাচ্ছে এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের লোকজনের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। এলাকাবাসীর ভয়ে শ্রমিকরা ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না।
একান্ত প্রয়োজন না হলে অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বসতবাড়ি এবং চাষযোগ্য জমি এড়িয়ে যাওয়ার নির্দেশনা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে অদূদর্শিতার কারণে বিপাকে পড়েছে বড়ভিটা নামে একটি গ্রামের অধিবাসীরা।
প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর ওই গ্রামের অধিবাসীদের বের হওয়ার কোনো রাস্তা থাকবে না। এছাড়া প্রকল্পের মাঝখানে এ ধরণের গ্রাম প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং প্রকল্পের সৌন্দর্য নষ্ট হবে। এ অবস্থায় বড়ভিটা গ্রামে ২০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে গ্রামবাসীকে অন্য কোনো স্থানে পুনর্বাসনের প্রস্তাব করছে আইএমইডি।
৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের প্রকল্পে নিয়মিত প্রকল্প পরিচালক রাখার কথা থাকলেও চলমান এ প্রকল্পটিতে এখন পর্যন্ত ৬ জন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন হয়েছে। নতুন প্রকল্প পরিচালক দায়িত্ব নিয়ে কাজ বুঝে নিতে ৬ মাসের মতো সময় প্রয়োজন হয়। প্রকল্পটি ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদল হওয়ায় কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে বলে জানান আইএমইডি কর্মকর্তারা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের অবস্থার জামালপুরের সদরে। কিন্তু প্রকল্পের অফিস ঢাকার কাওরান বাজারে। জামালপুরে প্রকল্পের কোনো অফিস নেই।এ কারণে ঢাকা থেকে প্রকল্পের কাজ তদরকি করা কঠিন।