বিশ্বজুড়ে যেসব পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে
পৃথিবীব্যাপী ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ, কফি থেকে শুরু করে কয়লার মতো প্রায় সকল পণ্যের স্বল্পতার মুখে পড়ছেন। এজন্য প্রধানত কোভিডজনিত সরবরাহ বিচ্ছিন্নতাকে দায়ী করা হলেও, এর পিছনে রয়েছে আরো বেশকিছু কারণ।
প্রতিটি অনুঘটকের প্রভাবও ভিন্নভাবে পড়ছে। রয়েছে অঞ্চল ভেদে নির্দিষ্ট পণ্য স্বল্পতার গুরুত্বে তারতম্য।
এখানে আলোচিত দেশগুলোর পরিস্থিতি পুরো বিশ্ব বাজারকে আন্দোলিত করছে।
চীন: কয়লা ও কাগজ
চীনে সংকটের নানান দিক শক্তিশালী এক ঝড় হয়ে আঘাত হেনেছে, যার প্রভাব স্থানীয় ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সাথে সাথে বহির্বিশ্বেও অনুভূত হচ্ছে।
কাগজ, খাদ্য, পোশাক শিল্প থেকে শুরু করে আইফোন চিপ, ঘূর্ণিপাকের আবর্ত থেকে কোনো পণ্যের উৎপাদনই ছাড় পায়নি বলে জানান অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি স্টাডিজের গবেষক ড. মিশাল মেইডান।
তার মতে, এর ফলে 'চলতি বছরের বড়দিন উৎসবের কেনাকাটায় পণ্য স্বল্পতা দেখা যাবে।'
সমস্যার মূলে রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সংকট, যার ফলে ২০টি রাজ্য লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে।
দেশটিতে উৎপাদিত অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ তৈরি হয় কয়লা পুড়িয়ে, কিন্তু বিশ্বব্যাপী পণ্যটির দর বেড়েছে। কিন্তু সরকার-নির্ধারিত মূল্যসীমার কারণে কয়লার দাম বাড়তি হলেও সে মূল্য ভোক্তাদের ওপর চাপাতে পারে না বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো। তাই তারা লোকসান কমাতে উৎপাদন কমায়।
খনি নিরাপত্তা নিশ্চিতের নতুন নীতিমালার কারণেও কয়লার উত্তোলন কমেছে দেশটিতে। সঙ্গে আরো কঠোর পরিবেশ সুরক্ষা আইন ও সাম্প্রতিক সময়ের বন্যাও প্রভাব ফেলেছে বলে জানান ড. মেইডান। যার অর্থ, চীনা পণ্যের চাহিদা বাড়লেও, কারখানাগুলোকে বিদ্যুৎ ব্যবহার কমাতে বা কিছুদিনের জন্য উৎপাদন বন্ধ রাখতেও বলা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র: খেলনা ও টয়লেট পেপার
হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেছেন, 'এবারের বড়দিনে অনেক পণ্যই পাবেন না আমেরিকানরা।'
বড়দিনে রয়েছে শিশুদের খেলনা উপহার দেওয়ার চল। এবার কচিকাঁচাদের খেলনা মজুদও নিঃশেষিত প্রায় গুদামঘরে।
একইরকম অভাব দেখা যেতে পারে অন্যতম প্রধান নিত্যপণ্য টয়লেট পেপার থেকে শুরু করে পোশাক ও গৃহপালিত পশুর মোড়কজাত খাদ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহ সমস্যার প্রধান কারণ বন্দরে জাহাজ জট। দেশটিতে যত কন্টেইনারবাহী জাহাজ আসে, তার প্রতি ১০টির মধ্যে চারটি ভেড়ে ক্যালিফোর্নিয়ার মাত্র দুটি বন্দর, লস অ্যাঞ্জেলস ও লং বিচে।
গত সেপ্টেম্বর মাসের একটি দিনে রেকর্ডসংখ্যক ৭৩টি জাহাজ লস অ্যাঞ্জেলস বন্দরের বহির্নোঙরে অপেক্ষা করছিল। অথচ মহামারির আগের স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক দুই থেকে একটি জাহাজকেই অপেক্ষা করতে হতো।
জট কমাতে সপ্তাহের প্রতিটি দিন ২৪ ঘণ্টা চালু রকাহা হয়েছে উভয় বন্দরের কার্যক্রম।
অন্যান্য দেশের কোভিডজনিত সমস্যার কারণও যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহ সমস্যার পেছনে ভূমিকা রাখছে। যেমন, আমেরিকান স্পোর্টসওয়্যার জায়ান্ট নাইকি তাদের অধিকাংশ পণ্য দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ভিয়েতনামের মতো দেশে উৎপাদন করে। কিন্তু দেশটিতে অনেক কারখানাই বন্ধ রয়েছে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধের উদ্দেশ্যে।
তবে পণ্য উৎপাদিত হলেও তা আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দেওয়া আরো কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেন হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক উইলি শিহ।
তিনি বলেন, 'আমেরিকান ভোক্তাদের উদারহস্তে খরচ বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা গেলেও, কারখানা পর্যায়ে উৎপাদনে বিঘ্ন, বন্দরে মাত্রাতিরিক্ত পণ্য খালাসের চাপ এবং সড়ক ও রেল নেটওয়ার্কে পরিবহনের সমস্যা সংকোচনের জন্ম দিয়েছে।'
ভারত: মোটরকার ও কম্পিউটার চিপস
ভারতের সবচেয়ে বড় মোটরকার উৎপাদক মারুতি সুজুকির উৎপাদন কমে গেছে। যার প্রধান কারণ বিশ্বব্যাপী কম্পিউটার চিপের সংকট।
আধুনিক মোটরযানে এসব চিপস ইঞ্জিনে জ্বালানি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে জরুরি গতিরোধে (ব্রেক) ব্যবহৃত হয়। মহামারি জনিত কারণে চিপ উৎপাদক দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে এ সংকট।
শুধু ভারতে নয়, গোটা বিশ্বেই কম্পিউটার চিপ একটি প্রধান যন্ত্রাংশ, যা স্মার্টফোন থেকে শুরু করে কম্পিউটার উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। মহামারি হানা দেওয়ার আগেই ফাইভ-জি প্রযুক্তি রপ্তের প্রতিযোগিতায় পণ্যটির চাহিদা তরতর করে বাড়ছিল। কোভিড-১৯ আঘাত হানার পর ঘরে থেকে কাজ করার প্রসার বাড়ায় চাহিদা নতুন মাত্রা লাভ করে।
ভারতের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি যন্ত্রাংশের স্বল্পতাকে আরো বাজে রূপ দেয়। এখানেও বিদ্যুৎ সমস্যার প্রধান কারণ পর্যাপ্ত কয়লার অভাব।
মহামারির ভয়াল দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর ভারতের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে থাকে। কিন্তু একইসময় বিশ্ববাজারে কয়লার দাম চড়তে থাকে, আমদানি করেও চাহিদা পূরণ হয়নি।
এনিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি কোল ইন্ডিয়া লিমিটেডের সাবেক প্রধান জোহরা চ্যাটার্জি জানান, সর্বস্তরেই এর প্রভাব পড়েছে। 'একবার কয়লার অভাব দেখা দিলে সিমেন্ট, ইস্পাত, অবকাঠামো নির্মাণ থেকে শুরু করে আমাদের সম্পূর্ণ উৎপাদন খাত ব্যাহত হয়।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, ফলে ভারতীয় পরিবারগুলোও নিত্যপণ্য কিনতে সমস্যার মুখে। ইতোমধ্যেই বেড়েছে খাদ্য ও তেলের দাম।
ব্রাজিল: কফি ও পানি
শতাব্দীকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খরার শিকার হয়েছে ব্রাজিল, যা চলতি বছর দেশটির কফি ফসল সংগ্রহে লক্ষণীয় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
কফি চাষের প্রাকৃতিক চক্রে ব্যাঘাতে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছে উৎপাদন। কফি উৎপাদকদের চ্যালেঞ্জ আরো কঠিন রূপ নিয়েছে জাহাজে পরিবহনের উচ্চ খরচ ও কণ্টেইনার স্বল্পতায়।
ব্রাজিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় কফি রপ্তানিকারক হওয়ায় সব মিলিয়ে উৎসে খরচ বৃদ্ধির প্রভাব বিশ্বের সকল প্রান্তের ক্যাফেটেরিয়াগুলোর ওপর পড়বে।
এদিকে খরার কারণে বেড়েছে ব্রাজিলের বিদ্যুৎ সংকট।
দেশটির বেশিরভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় জলাধারে সঞ্চিত পানি প্রবাহের মাধ্যমে। কিন্তু সেই পানির অভাব দেশটির বিদ্যুৎ সরবরাহকে সরাসরি প্রভাবিত করছে।
বিদ্যুতের দাম চড়তে থাকায় সাধারণ মানুষকে ব্যবহার পরিমিত করার আহবান জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। নাহলে সরকার রেশনিং এর মতো ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
ওয়াশিংটন পোস্টকে দেশটির বিদ্যুৎমন্ত্রী বলেছেন, সরকারি সংস্থাগুলোকেও তাদের নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবহার ২০ শতাংশ কমাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
- সূত্র: বিবিসি