পোশাক খাতে উদ্বৃত্ত কার্যাদেশে ৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিগুলো পুনঃউন্মুক্ত হওয়ায় দেশের পোশাক শিল্প বিপুল কার্যাদেশ পেয়েছে, যাতে করে দেশীয় পোশাক শিল্পে তিন লাখ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এরমধ্যেই আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমের জন্য মহামারি পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে ১৫-২০ শতাংশ বেশি অর্ডার এসেছে। যা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার চেয়েও বেশি। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ক্রেতাদের বাড়তি চাহিদার কারণে বিপণীগুলো তাদের খালি তাক পূরণে ব্যস্ত হওয়ায় এত বিপুল অর্ডার আসছে বলে, তারা উল্লেখ করেছেন।
পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, কার্যাদেশ দেওয়া বেশিরভাগ বিদেশি ব্র্যান্ডের বিপণীকেন্দ্রে পর্যাপ্ত কালেকশন না থাকায়, তারা অর্ডারের সংক্ষিপ্ত 'লিড টাইম' দিয়েছেন। এ ধরনের ক্রমবর্ধমান অর্ডার পূরণ করতে প্রায় সকল কারখানাই শ্রমিক নিয়োগ বাড়িয়েছে।
এনিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন- বিজিএমইএ'র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, "ক্রেতাদের ক্রমবর্ধমান পোশাক চাহিদা পূরণে পোশাক শিল্পে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কর্মীর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, সংখ্যায় যা প্রায় ৩ লাখ হতে পারে।"
তিনি বলেন, "অতিরিক্ত কার্যাদেশ পূরণে গার্মেন্টস শিল্পে দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন, তবে আমাদের দেশে দক্ষ ও অর্ধ-দক্ষ পোশাক শ্রমিক তৈরির জন্য দরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অভাব রয়েছে। সরকার দক্ষতা উন্নয়নে মনোনিবেশ করলে তা পোশাক শিল্পে আরও কর্মসংস্থান তৈরির সহায়ক হবে।"
ম্যাপড ইন বাংলাদেশের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ৩,৩৮৪টি রপ্তানি-নির্ভর পোশাক কারখানা রয়েছে, ২৬ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬ জন কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানে।
আজিম জানান, "যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যে সফল টিকাদানের পর অধিকাংশ বিপণীকেন্দ্র খুলেছে এবং মানুষের হাতে পোশাকের পেছনে ব্যয় করার মতো অর্থও আছে। তবে বেশিরভাগ দোকানে হাল ফ্যাশনের কালেকশন কম থাকায়, তারা সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে সংগ্রহে উদ্যোগী হয়েছে।"
বিজিএমইএ সহ-সভাপতির সাথে একমত পোষণ করে পোশাক শ্রমিক নেতা নাজমা আক্তার বলেন, "প্রায় সকল কারখানা সক্ষমতার চাইতে বেশি অর্ডার পেয়েছে এবং তাদের প্রায় সকলেই নতুন কর্মী নিচ্ছে।"
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, অনেক কাজের চাপ থাকায় দীর্ঘদিন পর এখন বিপুল সংখ্যক কারখানা ডবল শিফটে চলছে।
নাজমা আরও জানান, মিয়ানমারে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বেশিরভাগ ক্রেতা সেখানে অর্ডার দিয়ে অনিশ্চিত অবস্থায় পড়তে চান না। পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অন্যান্য প্রতিযোগী দেশগুলো এখনও কোভিড সংক্রান্ত সমস্যার মুখে, যা বাংলাদেশের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বেশিরভাগ ক্রেতাই এখন এদেশে অর্ডার নিয়ে আসছেন।
বাংলাদেশ নিটওয়ার ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ফজলে শামিম এহসান বলেন, "বাংলাদেশে এখন বিপুল অর্ডার আসছে, তাই আমাদের ক্রেতা বাছাইয়ে মনোযোগী হয়ে সস্তার চেয়ে তুলনামূলক দামি পণ্যের অর্ডার নিতে হবে। অধিক পরিমাণে উৎপাদনের চাইতে মূল্য বাড়িয়ে মুনাফা সীমা বাড়ানোর এটাই উপযুক্ত সময়।"
এখাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জেনেছে যে, বেশ কিছু কারখানা উৎপাদন কার্যক্রম ৪০ লাইন পর্যন্ত বাড়িয়েছে। কিছু কারখানা চলতি বছরের মধ্যে আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।
ইতঃপূর্বে বন্ধ হওয়া লাইনগুলোও সচল করছে কারখানাগুলো, এমনকি মহামারির প্রথম তরঙ্গে বন্ধ হওয়া কারখানাও সচল হয়ে পুনরায় শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছে।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম শাওন বলেন, "মহামারির সময়েও আমরা উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়েছি এবং প্রায় ২ হাজার জনকে নিয়োগ দিয়েছি।" আরও ব্যাখ্যা করে তিনি জানান, চলতি মাসে তাঁর প্রতিষ্ঠান আরও ৬ লাইন বৃদ্ধি করে ৮৬টিতে উন্নীত করেছে।
"ক্রেতার সম্মতি নিয়ে বাড়তি কিছু কাজ আমরা সাব-কন্ট্র্যাক্টর কারখানাগুলোকে দিয়ে করাচ্ছি, স্বল্প সময়ে ক্রেতাদের তরফ থেকে সরবরাহের চাপ থাকার কারণেই এমনটি করতে হচ্ছে।"
শোভন ইসলাম জানান, তারা এখন ভালো দর পাচ্ছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আগের চেয়ে ৬ শতাংশ বেশি মূল্যও দিচ্ছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান।
তিনি আরও বলেন, মহামারির সময়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অনেক কারখানা তাদের উৎপাদন সক্ষমতার একাংশ বন্ধ রাখলেও, বিপুল অর্ডারের কারণে তারা পুনরায় সক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেছে।
এসব কারখানাও এখন দক্ষ শ্রমিকের সন্ধান করছে বলে জানান তিনি।
স্প্যারো গ্রুপ এমডি উল্লেখ করেন যে, যেসব কারখানা সকল ধরনের কমপ্ল্যায়েন্স নিশ্চিত করেছে, তাদের কোন কর্মী সংকট নেই।
অনন্ত অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির বলেন, তারা এখন ভালো দামে নতুন অর্ডার পাচ্ছেন তবে পরবর্তীতে দেওয়া বাড়তি অর্ডারে এখনও ১৫-২০ শতাংশ কম দাম দিচ্ছেন ক্রেতারা।
টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ হিল রাকিব জানান, তাঁর গ্রুপটি একটি নতুন জ্যাকেট তৈরির কারখানা স্থাপন করেছে, যার সক্ষমতা ৮৫ লাইন। এরমধ্যেই ৬৩ লাইন সচল হয়েছে, যাতে কাজ করছেন ৮ হাজার শ্রমিক।
তিনি বলেন, "কারখানাটি প্রথমে ১৮টি লাইন নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে, এরপর কোভিডের মধ্যেও গত জুলাই থেকে আরও শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়। আমরা আরেকটি আইইডি প্ল্যাটিনাম ডেনিম কারখানা নির্মাণ শুরু করেছি, এতে জিরো ডিসচার্জ ২২ লাইনের ওয়াশিং প্ল্যান্ট থাকবে। আগামী বছরের ডিসেম্বর থেকে এটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হবে।"
স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ বলেন, "মহামারি কালে আমরা পাঁচ হাজার কর্মী নিয়োগ দিয়েছি, এখন আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১৭ হাজার। আগামী চার মাসের মধ্যে আমরা আরও দুই হাজার কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা করছি।"