পুরনো ড্রামে কোটি টাকার বাণিজ্য
- মাসে প্রায় ২০ হাজার ড্রাম বিক্রি হয় যার বাজার মূল্য ৩ কোটি টাকা
- দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেরী করে ড্রামগুলো বিক্রি হয়
- ড্রাম ব্যবসায় কর্মসংস্থান হয়েছে তিন শতাধিক মানুষের
তিতাস নদীর তীর ঘেঁষেই নবীপুর ও দড়িলাপাং গ্রাম। নদী ভাঙনের সাথে যুদ্ধ করেই চলে এ দুই গ্রামের জনজীবন। এক সময় নুন আনতেই পান্তা ফুরাতো। তবে এখন দুই গ্রামের অর্থনীতি পাল্টে দিচ্ছে ঢাকার সোয়ারিঘাটের পুরনো লোহার ড্রাম। এই ড্রাম ব্যবসা করে মাসে প্রায় ১ কোটি টাকা আয় করছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার নবীপুর ও দড়িলাপাং গ্রামের মানুষ। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই পুরনো ড্রাম বাণিজ্য আরও সম্প্রসারিত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মূলত ঢাকার সোয়ারী ঘাট থেকে তেল ও বিটুমিনের পুরনো ড্রাম কিনে আনেন নবীপুর ও দড়িলাপাং গ্রামের ব্যবসায়ীরা। একেকটি ড্রামের দাম পরে ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকা। এরপর ড্রামগুলোকে বিক্রির উপযোগী করতে খরচ হয় আরও ১০০ টাকা। দুই গ্রামে বড় ব্যবসায়ী আছেন মোট ২৪ জন। আর ছোট ব্যবসায়ী ২০-২৫ জন। এছাড়া এই ড্রাম ব্যবসার ফলে কর্মসংস্থান হয়েছে দুই গ্রামের তিন শতাধিক মানুষের।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নবীনগর উপজেলার নবীনগর পশ্চিম ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামে প্রায় ৩০ বছর আগে ড্রাম ব্যবসার সূচনা হয়। ওই গ্রামের বাসিন্দা সুরুজ মিয়া সর্বপ্রথম ড্রাম এনে ব্যবসা শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে বিস্তৃত হতে থাকে এই পুরনো ড্রামের ব্যবসা। নদীপথে নৌকায় করে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয় এসব ড্রাম। মূলত চৈত্র ও বৈশাখ মাসে ধানের মৌসুমে ড্রাম বেশি বিক্রি হয়। ড্রামগুলো ধান, চাল ও গমসহ অন্যান্য পণ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়।
লট হিসেবে কিনে আনা ড্রামগুলোর মধ্যে কিছু ড্রাম মেরামতের প্রয়োজন হয়। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিতাস নদীর তীরে ড্রামের প্রয়োজনীয় মেরামত কাজ করেন শ্রমিকরা। প্রতিটি ড্রামেই ঢাকানা সংযোজন করা হয়। এজন্য ড্রাম প্রতি শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হয় ৬০ টাকা করে। একেকটি ড্রামের প্রয়োজনীয় মেরামত ও ঢাকনা সংযোজনে শ্রমিকদের প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে। পরবর্তীতে ড্রামগুলো ধুয়ে-মুছে রং করা হয়।
ড্রামগুলো বিক্রির জন্য নদীপথে নৌকায় করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই গ্রামের ব্যবসায়ীদের বড় নৌকা আছে ২৪টি এবং ছোট নৌকা আছে ৩-৪টি। বড় নৌকাগুলোতে ৪০০ পিস ড্রাম এবং ছোট নৌকাগুলোতে ১০০ পিস ড্রাম ধারণ করে। এছাড়া ড্রাম বিক্রি করার জন্য বড় নৌকাগুলোতে শ্রমিক থাকে ৮-১০ জন। নৌকাগুলো ড্রাম নিয়ে বিভিন্ন এলাকার ঘাটে ভিড়ে। এরপর গ্রামে-গ্রামে ঘুরে ফেরী করে বিক্রি হয় ড্রামগুলো।
ড্রাম নিয়ে রওনা হওয়ার পর বড় একেকটি নৌকার ৪০০ পিস ড্রাম বিক্রি করে শ্রমিকদের গ্রামে ফিরে আসতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। আর ছোট নৌকার ১০০ পিস ড্রাম বিক্রিতে সময় লাগে ২-৩ দিন। প্রতিটি ড্রাম ১৪ থেকে ১৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। এভাবে নবীপুর ও দড়িলাপাং থেকে প্রতি মাসে প্রায় ২০ হাজার ড্রাম বিক্রি হয়। যার মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। প্রতি পিস ড্রামে ব্যবসায়ীদের লাভ হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।
ড্রাম মেরামতের কাজ করা নবীপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. শান্তি মিয়া জানান, তিনি ১৫-১৬ বছর ধরে ড্রাম মেরামতের কাজ করছেন। প্রতিদিন ১০-১২টি ড্রাম মেরামত করে ঢাকনা সংযোজন করেন। এ কাজ করে দৈনিক ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় করেন তিনি। এই টাকায় তার সংসার ভালোভাবেই চলছে বলে জানান তিনি।
আরেক শ্রমিক শাহাবুদ্দীন জানান, ড্রাম ব্যবসার কারণে গ্রামেই তাদের কর্মসংস্থান হয়েছে। দুই গ্রামে অনেক বেকার যুবক এখন ড্রাম মেরামত এবং ফেরী করে ড্রাম বিক্রির কাজ করছেন। ড্রাম মেরামতের কাজ করে একেকজন শ্রমিক দৈনিক ৭০০-৮০০ টাকা আয় করতে পারেন।
ড্রাম ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুরনো ড্রাম বাণিজ্যে দুই গ্রামের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত করা সম্ভব। গ্রামের আরও অনেকে এ ব্যবসায় আসতে চাইলেও অর্থের অভাবে তারা আসতে পারছেন না। সেজন্য সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
দড়িলাপাং গ্রামের ড্রাম ব্যবসায়ী মো. রুবেল বলেন, 'একেকটি নৌকায় আমাদের ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা বেশি পুঁজি খাটাতে হয়। মাসে প্রায় ২০ হাজার পিস ড্রাম বিক্রি হয় দুই গ্রাম থেকে। এই ব্যবসা করে আমাদের দুই গ্রামের অনেকের ভাগ্য বদল হয়েছে। তবে পুঁজির অভাবে আমরা ব্যবসা বড় করতে পারছিনা। যদি আমাদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ দেওয়া হয়, তাহলে এই ড্রাম ব্যবসা আরও বেশি সম্প্রসারিত হবে। নতুন করে আরও অনেকে এ ব্যবসায় আসবেন'।
আরেক ব্যবসায়ী খলিল মিয়া বলেন, 'ড্রাম ব্যবসা করে আমাদের পাশাপাশি শ্রমিকরাও উপকৃত হচ্ছে। গ্রামের বাইরে না গিয়েও ভালো টাকা আয় করছে তারা। এতে করে বেকারত্ব কমছে। এখন মালিক-শ্রমিক দুই পক্ষই ভলোভাবে চলতে পারছে'।
নবীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) একরামুল ছিদ্দিন বলেন,'ব্যবসায়ীরা যদি আমাদের কাছে সহযোগিতার জন্য আবেদন করেন, তাহলে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে কিছু করা যায় কিনা, সেটি আমরা দেখব'।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যাংকার্স ফোরামের সভাপতি ও সোনালী ব্যাংকের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রধান শাখার ব্যবস্থাপক মো. ইকবাল হোসেন বলেন,'ঋণের জন্য কয়েকজন ব্যবসায়ী মিলে একটি করে গ্রুপ করতে হবে। এরপর ওই গ্রুপের মাধ্যমে তাদেরকে ব্যবসার পূর্ণ বিবরণ দিয়ে ঢাকায় ঋণের জন্য আবেদন করতে হবে। যদি এটি কোনো শিল্প হয়ে থাকে, তাহলে ব্যবসায়ীরা ৪ শতাংশ হারে ঋণ পেতে পারেন'।