পতনের পথে স্টাইলক্রাফট লিমিটেড
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান স্টাইলক্রাফট লিমিটেড ২০১৫ সালে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি করে। কিন্তু ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি বকেয়া মজুরি নিয়ে শ্রমিকদের বিক্ষোভের মধ্যে এর মাত্র ছয় বছর পরেই জুলাই মাসে তার কারখানা বন্ধ করে দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, বর্তমানে তার অবস্থা শোচনীয়।
তিনি বলেন, "গত ১০ মাস ধরে ভাড়া দিতে পারিনি। জানি না, কীভাবে আমার সংসার চলবে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আত্মহত্যাই এখন আমার একমাত্র উপায়, কিন্তু আমার বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে তাও পারি না"।
আরেকজন কর্মকর্তা, এবং কোম্পানির সাবেক সহকারী ব্যবস্থাপক বলেন, জুলাই মাসে কারখানা বন্ধ হওয়ার পর তিনি গাজীপুরে বিক্রির জন্য ব্যবহৃত পোশাক (ইউজড গার্মেন্টস) কিনতে শুরু করেন। কিন্তু করোনা মহামারি সেই পথটিও বন্ধ করে দিয়েছে। এরপর তিনি তার গ্রামে ফিরে যান; সেখানেই এখন দুইজন শিক্ষার্থীকে পড়ান এবং একটি জেনারেল স্টোরে খণ্ডকালীন চাকুরী করেন।
এই কর্মকর্তার মেয়েটি আগে গাজীপুরের একটি বেসরকারি স্কুলে পড়াশোনা করত। এখন, তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছে কারণ সেখানে বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির এরূপ পতনের জন্য প্রতিষ্ঠাতা শামসুর রহমানের দুই ছেলের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা হচ্ছে। একের পর এক বেপরোয়া বিনিয়োগের ফলে ডুবতে বসেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে মঙ্গলবার দুপুর থেকে রাজধানীর বিজয়নগরে শ্রম ভবনের সামনে বিক্ষোভ করছেন কারখানার শ্রমিকেরা।
আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শ্রম প্রতিমন্ত্রী কারখানার মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কিন্তু এখনো কোনো সমাধান হয়নি।
আজ মন্ত্রীর সঙ্গে আরেকটি বৈঠক হওয়ার কথা থাকায় শ্রমিকরা গতকাল সারারাত শ্রম ভবনের সামনে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।
কোম্পানিটির ৪,৩০০ জন কর্মীর ৪ মাস থেকে সর্বোচ্চ ১৪ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে বলে জানা গেছে।
দ্বিতীয় প্রজন্মের তত্ত্বাবধান
১৯৮৩ সালে স্টাইলক্রাফট প্রতিষ্ঠা করেন শামসুর রহমান। সুশাসন নিশ্চিতের জন্য তিনি কোম্পানিটিকে ওই বছরেই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করেন। পরবর্তীতে ব্যবসা এগিয়ে নিতে তার দুই সন্তানকে কোম্পানির উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে কাজ করিয়েছেন শামসুর।
এই দুই সন্তানের মধ্যে শরীফ আলমাস রহমান ১৯৮৭ সাল থেকে এবং শামস আলমাস রহমান ২০০২ সাল থেকে কোম্পানিটিতে কাজ করছেন।
পরে শামস আলমাস ২০১০ সালে এবং শরীফ আলমাস ২০১৬ সালে স্টাইলক্রাফটের পরিচালক পদে যোগ দেন। বর্তমানে শরীফ আলমাস কোম্পানিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
শামসুর রহমান ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ সালে মারা যান। তিনি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। গাজীপুরে তিনি মাঝারি আকারের একটি কমপ্লায়েন্স ফ্যাক্টরি গড়ে তুলেন। তখন পর্যন্ত এর ব্যবসাও ভালভাবে চলছিল।
তিনি মারা যাওয়ার পর তার ছেলে শামস আলমাস কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে বসেন। কোম্পানি পরিচালনার ক্ষমতা পেয়ে তিনি স্টাইলক্রাফটের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন নতুন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন।
নিয়মিত ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয়া কোম্পানিটি ২০১৭ সাল থেকে ব্যবসা সম্প্রসারণের নামে বড় অংকের স্টক ডিভিডেন্ড দেয়া শুরু করে।
এই সময় কোম্পানিটির এই দুই পরিচালক যুক্তরাজ্যে মোদা সেনজা রিমোরসি লিমিটেড নামে একটি রিটেইল পোশাক কোম্পানি এবং টঙ্গীতে একটি ওয়াশিং প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠা করেন।
কোম্পানিটির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই দুই ভাই স্টাইলক্রাফটের টাকা সরিয়ে ওইসব জায়গায় বিনিয়োগ করেন। কিন্তু কোনোটিতেই সফল হতে পারেননি।
এদিকে শামসুর রহমানের ছেলেদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় কোম্পানিটির দীর্ঘদিনের সঙ্গী ও অভিভাবক ওমর গোলাম রব্বানী চেয়ারম্যান পদ থেকে ২০২০ সালের শেষ দিকে সরে দাঁড়ান।
এছাড়া স্টাইলক্রাফটের দীর্ঘদিনের বড় ক্রেতা জাপানের ইউনিক্লো নন-কমপ্লায়েন্সের অভিযোগে ২০১৯ সালে সম্পর্ক ছিন্ন করে। অথচ তাদের মোট উৎপাদনের ৬০ ভাগই ইউনিক্লো এর অর্ডারে হত। তারপর কিছুদিন এইচ এন্ড এমের কিছু অর্ডার পেলেও করোনা মহামারির কারণে সেটা বন্ধ হয়ে যায়।
পরিণতিতে কোম্পানিটির কর্মকর্তা এবং শ্রমিকদের ৪ মাস থেকে সর্বোচ্চ ১৪ মাসের বেতন বকেয়া হয়েছে।
কোম্পানিটির ২০১৯-২০ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাদের কারখানায় ৩,৫০০ শ্রমিক এবং ৪২০ জন কর্মকর্তা রয়েছেন।
বকেয়া বেতনের দাবিতে চলতি বছরের এপ্রিলে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেন। পরে আগস্ট মাসে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ানের নেতৃত্বে সরকার ও ব্যবসায়ী সংগঠনের মধ্যস্থতায় স্টাইলক্রাফটকে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধের সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এরপরও তারা বেতন পরিশোধে ব্যর্থ হয়।
এদিকে ২০২০ এর মার্চ থেকে টঙ্গীর বন্ধ থাকা ওয়াশিং প্ল্যান্ট বিক্রির চেষ্টা করেন দুই ভাই। কিন্তু এই প্ল্যান্টের বিপরীতে ব্যাংকের ঋণ থাকায় বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। তাই নির্ধারিত সময়ে বেতন পরিশোধ সম্ভব হয়নি বলে জানান কোম্পানিটির একাধিক সাবেক কর্মকর্তা।
বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিকেরা আবারও রাস্তায় নামলে কোম্পানিটির পক্ষ থেকে ২৬ অক্টোবর একটি নোটিশ দেয়া হয়।
স্টাইলক্রাফটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস আলমাস রহমান স্বাক্ষরিত সে নোটিশে বলা হয়, গত ৭ অক্টোবর তাদের মায়ের মৃত্যু হয়। তিনি কোম্পানিটির পরিচালক পদে ছিলেন। তাই কোম্পানিটির আর্থিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে শিগগিরই এই অবস্থা কেটে যাবে। এবং আগামী ৪ নভেম্বর কারখানা খোলা হবে। পাশাপাশি আগামী ১৫ দিন অর্থাৎ ২১ নভেম্বরের মধ্যে এক মাসের বেতন পরিশোধ করা হবে। বাকি টাকা ক্রমান্বয়ে শোধ করা হবে। তবে দাপ্তরিক কাজ করার জন্য উত্তরাধিকার সনদপত্র পেতে দেরি হলে টাকা পরিশোধে আরো সময় লাগতে পারে।
এই বিষয়ে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, কোম্পানি সেক্রেটারি এবং প্রধান অর্থ কর্মকর্তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেননি।
নামেই টিকে আছে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়
পরে তাদের মন্তব্যের জন্য মহাখালীতে কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয়ে দ্য বিজিনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদক যান। সেখানে দেখা যায় যে, পুরো অফিস ফাঁকা। মাত্র দুই জন কর্মকর্তা ও একজন পিয়ন রয়েছে। পিয়নের মাধ্যমে কোম্পানি সেক্রেটারি লিখিত আকারে প্রশ্ন দিতে বলেন। কিন্তু লিখিত আকারে প্রশ্ন দেয়ার প্রায় দশ দিন পেরিয়ে গেলেও তিনি কোন জবাব দেননি।
বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিকারক ও মালিক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি মোঃ নাসির উদ্দিন বলেন, "কোম্পানিটির সম্পদের চেয়ে দেনা বেড়ে গেছে। তাই কোন ব্যাংক নতুন ঋণ দিচ্ছে না। তবে শ্রমিকের স্বার্থে আমরা চেষ্টা করছি কোন সমাধান করা যায় কি না"।
কোম্পানির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দীর্ঘদিনের অংশীদার পূবালী ব্যাংক প্রত্যাখ্যান করায় অন্য একটি ব্যাংক থেকে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করছে কোম্পানিটি। সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে অগ্রণী ব্যাংকের নাম উল্লেখ করেন তিনি।
আইনের লঙ্ঘন
কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালে তারা সবচেয়ে ভাল ব্যবসা করেছে। সে বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি হয়েছে। ২০১৯-২০ হিসাববছরে তাদের রাজস্ব ২০০ কোটি টাকায় নেমে আসে। করোনার দোহাই দিয়ে ব্যবসা কমেছে বলে জানায় কোম্পানিটি।
কিন্তু এই পতনের ধারা ২০২০-২১ হিসাববছরেও বজায় রয়েছে। সে বছরের প্রথম ৯ মাসে তাদের বিক্রি ৪১ শতাংশ কমে ৯৮ কোটি টাকা হয়েছে এবং লোকসান হয়েছে প্রায় ৮ কোটি টাকা।
এদিকে জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানিটির শেয়ার দর ৪১ শতাংশ বেড়ে ২০৩ টাকা হয়েছিল। অথচ জুলাই থেকে তাদের কারখানা বন্ধ। আর এ খবর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে শেয়ারহোল্ডারদেরও জানানো হয়নি, যা সিকিউরিটিজ আইনের লঙ্ঘন।
তবে সর্বশেষ গত সোমবার পর্যন্ত এর শেয়ার দর কমে দাঁড়িয়েছে ১৩৬.৫০ টাকা।
এদিকে কোম্পানিটির কারখানা খুলছে এমন খবরে মঙ্গলবার এর শেয়ার দর ৭.৩৩ শতাংশ বেড়েছে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এর মুখপাত্র মোঃ রেজাউল করিম বলেন, "বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে"।
এর আগে ২০১৮ সালে বড় স্টক ডিভিডেন্ড দিচ্ছে এমন গুজব ছড়িয়ে কোম্পানিটির শেয়ার দর ৬০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে তারা ৪১০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড দিয়েছিল। এ কারণে কোম্পানিটির এক পরিচালক ও কোম্পানি সেক্রেটারিকে আর্থিক জরিমানা করেছিল বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন।