দেশীয় উৎপাদন যেভাবে সহজ করেছে মানুষের জীবন
আজ থেকে সাত-আট বছর আগেও বাংলাদেশের ব্লাড ক্যান্সারের রোগীদের আমদানিকৃত প্রতি ডোজ রিটাক্সান ইনজেকশন এক লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হতো। বলাই বাহুল্য, বেশিরভাগ মানুষের সাধ্যের বাইরে ছিল এ দাম।
এই ইনজেকশনের দাম কমে এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে, কারণ দেশের স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোই এখন জীবন রক্ষাকারী নানা ওষুধ দেশেই তৈরি করে থাকে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বিদেশি কোম্পানিগুলোও এখন এই পণ্য দেশের বাজারে প্রায় ৫০ হাজার টাকা দামেই বিক্রি করছে।
দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো বর্তমানে ডায়াবেটিসের ইনসুলিন ৩৪৫-৩৬০ টাকায় বিক্রি করে থাকে। অথচ গত এক দশক যাবত আমদানিকৃত ইনসুলিন রোগীদের কিনতে হতো এর প্রায় দ্বিগুণ দামে। এক সময়ের ব্যয়বহুল অনেক ওষুধই এখন কম দামে পাওয়া যাচ্ছে, কারণ এগুলোর উৎপাদন দেশেই হচ্ছে।
শুধু জীবন রক্ষাকারী সামগ্রীই নয়, ইলেকট্রনিকস বস্তু, গৃহস্থালি সরঞ্জাম, অটোমোবাইল প্রভৃতি ভোগ্যপণ্যের মূল্যও আগের চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী হয়েছে। উদ্যোক্তাদের স্থানীয়ভাবে পণ্য উৎপাদন ও সরকারের সহায়ক নীতির কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে।
রপ্তানি নির্ভর পোশাকশিল্পের খাতও বাংলাদেশের বাণিজ্যের স্বনির্ভরতা অর্জনে ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর সাধারণ পরিচালক ড. কে এ এস মুরশিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মানুষের জীবনধারণকে আরও সহজ করে তোলাই উন্নয়ন। আমাদের উদ্যোক্তারা দেশেই বিভিন্ন পণ্য ও সামগ্রী উৎপাদনের মাধ্যমে একাজটিই করছেন।"
"এখন আমাদের রপ্তানির ওপর নজর দিতে হবে। শিল্পায়ন যেন পরিবেশের ওপর কোন বিরূপ প্রভাব ফেলতে না পারে সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।" যোগ করেন তিনি।
ইলেকট্রনিক্স ও গৃহস্থালি সরঞ্জাম উৎপাদনে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি
আজকাল রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন এমনকি ল্যাপটপ, কম্পিউটারও অধিক সংখ্যক মানুষের হাতের নাগালে, কারণ ব্র্যান্ডগুলো কর এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ার মাঝে ভারসাম্য রাখতে বাংলাদেশেই স্থানীয়ভাবে পণ্য উৎপাদনের দিকে গুরুত্বারোপ করছে।
আর ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের বাজার এখন আর ফিলিপস, সনি, প্যানাসনিকের একচেটিয়া দখলে নেই। প্রযুক্তির বাজারে সমতা সমতা আনতে ভূমিকা রেখেছে চীনা পণ্য। চীনা প্রযুক্তির উন্নতি ছাড়া উঠতি কোম্পানিগুলোর জন্য বাজারে ভিত শক্ত করা অনেকটাই কঠিন হতো।
১২ বছর আগে তরুণ স্কুল শিক্ষক শারমিন আক্তারকে টানা দুই বছর ধরে ৩৮ হাজার টাকা সঞ্চয় করতে হয়েছিল একটি আমদানিকৃত ফ্রিজ কেনার জন্য। বর্তমানে বাংলাদেশের স্থানীয় কোম্পানি ওয়ালটনই একই মাপের ফ্রিজ বিক্রি করছে মাত্র ২০ হাজার টাকায়। সেইসাথে আছে অধিক মেয়াদের ওয়ারেন্টি।
২০১০ সালে ব্যাংকার মাসুদ আহমেদ ৭০ হাজার টাকায় একটি আমদানিকৃত ওয়াশিং মেশিন কেনেন। অথচ গত বছর তারই ছোট ভাই আরও ভাল মানের একটি ওয়াশিং মেশিন কেনেন ৩০ হাজার টাকায়।
মাসুদ আহমেদ বলেন, "যেভাবে স্থানীয় উৎপাদন আমাদের ওপর আর্থিক চাপ কমাচ্ছে তা সত্যই প্রশংসনীয়।"
২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রযুক্তির বাজারে ওয়ালটনের আগমন যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে।
ইতোমধ্যেই রেফ্রিজারেটরের তিন চতুর্থাংশ, টেলিভিশনের ৪০ শতাংশ এবং এয়ার কন্ডিশনারের ২০ শতাংশ বাজারই বর্তমানে এ দেশীয় কোম্পানির দখলে। বাটারফ্লাই, প্রাণ-আর এফ এল এবং মিনিস্টার এর মত ব্র্যান্ডগুলোও এখাতে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে সিংগার, স্যামসাং, এলজির মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন স্থানীয়ভাবে তাদের পণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ করছে।
প্রযুক্তিগত, বিপণন এবং ব্যবস্থাপনায় ওয়ালটনের উন্নয়নের প্রচেষ্টার ফলে এটি সেরা পাঁচ ব্র্যান্ডের একটি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
ওয়ালটনের ভাইস- চেয়ারম্যান এসএম নুরুল আলম রিজভি বলেন, ওয়ালটন ২৫ হাজার মানুষকে সরসারি এবং এক লাখেরও অধিক মানুষকে অপ্রত্যক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়েছে।
মিনিস্টারের চেয়ারম্যান এমএ রাজ্জাক খান বলেন, "আমরা টিভি, ফ্রিজ, এসি, ব্লেন্ডার, রাইস কুকারসহ অন্যান্য অনেক গৃহস্থালি সরঞ্জামাদি তৈরি করছি। ফলে দেশের বাজারে এসব পণ্যের দাম কমেছে, একইসাথে পাঁচ হাজারের অধিক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।"
মোবাইল ফোনের বাজার চাঙ্গা
আমদানিকৃত মোবাইল ফোনের জন্য কর দিতে হয় ৫৭ শতাংশ, অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে মোবাইল উৎপাদনের করবাবদ খরচ মাত্র ১৭ শতাংশ।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের এই নীতির কারণে স্যামসাং আন্তর্জাতিক এবং ওয়ালটনের মতো স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো এখন দেশেই মোবাইল উৎপাদন করছে। অচিরেই মার্কিন ব্র্যান্ড মটোরোলাও বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে মোবাইল উৎপাদন শুরু করতে পারে।
এ খাতে আড়াই কোটির ওপর বিনিয়োগের কারণে মোবাইল ফোনের দাম আরও সাশ্রয়ী হয়েছে, একইসাথে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো বার্ষিক চাহিদার ৬০ শতাংশ পূরণ করে গত অর্থবছরে প্রায় তিন কোটি হ্যান্ডসেট বিক্রি করেছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে মোবাইল হ্যান্ডসেটের ভূমিকা অনস্বীকার্য ; মোবাইল আর্থিক পরিষেবাসমূহ দৈনন্দিন লেনদেনে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে। গ্রামীন ও শহুরে অনেক তরুণ বৈশ্বিক পরিসরে তাদের মেধা কাজে লাগানর সুযোগ পাচ্ছে।
বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাকচারিং এসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব রেজওয়ানুল হক টিবিএসকে জানান, প্রায় সব সরকারের আমলেই স্থানীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ এখাতে সঠিক পথেই এগোচ্ছে।
ওয়ালটন ইতোমধ্যেই দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মোবাইল ফোন রপ্তানির ঘোষণা দিয়েছে।
স্থানীয় গাড়ির বাজারের অনুপ্রেরণা মোটরসাইকেল খাত
খুব শীঘ্রই বাংলাদেশের নিজস্ব গাড়ি নির্মাণের স্বপ্নকে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে মোটরসাইকেল বাণিজ্য। পাঁচ বছর আগেও একটি ১০০ সিসির মোটরসাইকেলের দাম পড়ত দেড় লাখের কাছাকাছি।
গত দশকে এদেশে স্থানীয় পর্যায়ে মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরু করে রানার অটোমোবাইলস। রানার অটোমোবাইলসের পথ ধরেই পরবর্তীতে হিরো, বাজাজ, টিভিএস, হোন্ডা, সুজুকি, ইয়ামাহা এবং লিফানের মত জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোকে এদেশে স্থানীয়ভাবে মোটরভাবে মোটরসাইকেল উৎপাদনের কাজ শুরু করে।
বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই এখাতে আট হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে । কর ও শুল্ক হ্রাসের মতো সহায়ক নীতির ফলে এদেশে উৎপাদিত মোটরসাইকেলের দাম এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। যেভাবে স্থানীয় পর্যায়ে অটোমোবাইল প্রস্তুতকারীদের পেছনে বিনিয়োগকারীরা অর্থ লগ্নি করতে চাচ্ছেন তাতে সামনের দিনগুলোতে মোটরসাইকেল আরো সুলভ হয়ে উঠবে দেশের ক্রেতাদের জন্য।
গত চার বছরে মোটরসাইকেলের বার্ষিক বিক্রয় দুই লাখেরও কম থেকে পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ মোটরসাইকেল এসেম্বলারস এন্ড ম্যানুফ্যাকচারারস এসোসিয়েশনের সভাপতি মতিউর রহমান এর মতে, বাংলাদেশের মোটরসাইকেলের বাজার আগামী কয়েক বছরে ১০ লাখের মাইলফলক অতিক্রম করবে এবং বিনিয়োগকারীদের স্থানীয় বাজারে বিনিয়োগের সুযোগ বাড়বে।
এরই মধ্যেই দেশীয় কোম্পানি রানার এখন নেপালে মোটরসাইকেল রপ্তানি করছে, পাশাপাশি অন্যান্য খাতেও নজর রাখছে।
জীবনরক্ষাকারী ওষুধের ৯৭ শতাংশই দেশে উৎপাদিত
ফাইজার, গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন, সানোফি, নভোনরডিস্ক, নোভারটিসের মতো বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভর করে থাকার দিন আর নেই।
১৯৮০'র দশকে ওষুধ শিল্প নীতি স্থানীয় পর্যায়ে এই খাতের সম্প্রসারণে অবদান রাখে। বর্তমানে ৯৭ শতাংশ ওষুধ দেশেই তৈরি হয়ে থাকে; বছরে খরচ হয় সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা।
স্থানীয়ভাবে যেসব ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো বাজার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে তাদের প্রথম দশটিই দেশীয় প্রতিষ্ঠান । বিদেশি কোম্পানিগুলো এখন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে।
বেক্সিমকো, স্কয়ার, ইনসেপটা, এসিআই বিশ্বের ১৬০টি দেশের চিকিৎসকদের কাছে পরিচিত নাম।
২০১৮ সালের ওষুধ শিল্পে খাতে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের জন্য গৃহীত নীতির প্রশংসা করেন বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাপরিচালক এসএম শফিউজ্জামান।
বর্তমানে ওষুধ শিল্পের জন্য প্রণীত কাঁচামালের ১৫ শতাংশ দেশেই প্রস্তুত করা হয়। অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস (এপিআই) শিল্প পার্ক এর কার্যক্রম শুরু হবার পর এটি আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।
অন্যান্য আরও নানা ওষুধ সাশ্রয়ী হয়ে উঠবে সামনের দিনগুলোতে। এসিআইয়ের বিপণন পরিচালক মো মুহসিন জানান, স্থানীয় পর্যায়েই উচ্চমানের ওষুধ সামগ্রী উৎপাদিত হবে, সেই সাথে পশ্চিমা বাজারে উচ্চ মূল্যের ঔষধ রপ্তানির পথও সুগম হবে।
পোশাক ও বস্ত্রশিল্প
১৯৭০'র দশকের শেষদিকে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানি শুরু করে।
উদ্যোক্তাদের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগের কারণে দেশের ৮০ ভাগ রপ্তানি আয়ের বেশি এ খাত থেকে আসা শুরু হয়। এখাত থেকে প্রায় ৪০ লাখ লোকের কাজের সংস্থান হয়। তাদের সিংহভাগই ছিল স্বল্প দক্ষ নারী কর্মী।
এ শিল্প খাত নিছক কাটাকাটি ও সেলাইয়ের একটি মাধ্যম হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। তবে নতুন নতুন উদ্যোগ শীঘ্রই স্থানীয় পর্যায়ে মান বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
পোশাক বুনন রপ্তানি শিল্পে অর্ধেকেরও বেশি মূল্য এখন স্থানীয়ভাবে সংযোজিত হয়ে থাকে, ক্রেতাদের বিশেষ কোনো ক্রয়াদেশ ছাড়া নিটওয়্যার ক্ষেত্রেও এখন আর বহির্বিশ্ব থেকে কাপড় আমদানি করতে হয় না ।
স্থানীয় প্রস্তুতকারকরাই ৯০ শতাংশ পোশাক ও অনুষঙ্গের চাহিদা মিটিয়ে থাকে।
আরও সেবা আসছে
বিজনেস ইনিশিয়াটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) চেয়ারপার্সন এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান স্থানীয় প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধির ওপর গুরূত্বারোপ করেন। এছাড়াও তিনি স্বাস্থ্যসেবা, পর্যটন, আর্থিক সেবা, তথ্য প্রযুক্তি,টেলিযোগাযোগ, নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের মত পরিষেবা খাতগুলোতে তরুনদের আরো সংযুক্তির আহবান জানান।
দেশীয় নির্মাণ সংস্থা ম্যাক্স গ্রুপ ১৯৯০'র দশকেই বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মানে একটি সাবকন্ট্রাকটরের ভূমিকা পালন করে। এখন এই কোম্পানি ফ্লাইওভার এবং রেলপথ নির্মাণের মতো আরো অনেক মেগা প্রকল্পের সাথে জড়িত।
ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক টিবিএসকে জানান, তাদের চট্টগ্রাম ফ্লাইওভার প্রকল্প এখন স্থানীয় মান সংযোজনের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ সুফল দেখতে পাচ্ছে। গত দশকে একই শহরে তাদের নির্মিত প্রথম ফ্লাইওভার প্রকল্পের মান এরচেয়ে অনেক কম ছিল।
দেশীয় কোম্পানিগুলোকেই প্রকৌশল নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ প্রকল্পের কাজ তদারকের দায়িত্ব দেয়া হয়। তা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্যই হোক কিংবা আধুনিক সুসজ্জিত কারখানা।