দুই থেকে দুইশত বাস: স্টার লাইন গ্রুপের স্বপ্নযাত্রা
দুু'টি বাস দিয়ে পরিবহন ব্যবসা শুরু করে ফেনীভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান স্টার লাইন গ্রুপ। ১৯৯৮ সালে ফেনী-ছাগলনাইয়া রুটে যাত্রা শুরু করা এই শিল্প গ্রুপে এখন ৫০টি এসি বাসসহ ২০০ বাস চলাচল করে দেশের বিভিন্ন রুটে। ব্যবসায়ে নতুনত্ব, বৈচিত্রতা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় এই শিল্প গ্রুপের ব্যবসা ক্রমাগত সম্প্রসারিত হয়েছে। চট্টগ্রাম-ফেনী এবং ফেনী-ঢাকা রুটে প্রতি ৫ মিনিট পর পর বাস ছেড়ে যায় প্রতিষ্ঠানটির। এসব রুটে একচেটিয়া ব্যবসা স্টার লাইন বাসের।
পরিবহন ব্যবসার পাশাপাশি, হসপিটালিটি, পেট্রোল পাম্প, সিএনজি স্টেশন, ফুড, ফ্লাওয়ার মিল, কার্টন ফ্যাক্টরি, পোলট্রি ফার্ম, রাইস মিল, ওয়াটার ফ্যাক্টরি, সংবাদপত্রসহ ৩২ টি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এই শিল্প গ্রুপের। এসব প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে প্রায় ১১ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৯শ কোটি টাকা। বিনিয়োগ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে ব্যাংক ঋণ রয়েছে মাত্র ১৫৮ কোটি টাকা।
সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে স্টার লাইন গ্রুপ গড়ে তুলেছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ক্যাডেট কোচিং সেন্টারসহ বহু প্রতিষ্ঠান। নিজ শিল্প গ্রুপের কর্মীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের জন্য গড়ে তুলছে ৫০ শয্যার হাসপাতাল। করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসআর) বা করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে এই শিল্প গ্রুপ প্রতিবছর ব্যয় করেন কয়েক কোটি টাকা।
সম্প্রতি স্টার লাইন গ্রুপের পরিচালক মো: মাঈন উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কাছে তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানটির উত্থান ও চড়াই-উৎরাই পার হয়ে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছার গল্প।
পিতার স্বপ্নের পরিবহন ব্যবসা বিস্তৃত হলো সন্তানদের হাত ধরে
স্টার লাইন গ্রুপের উদ্যোক্তাদের পিতা এরশাদ উল্লাহর জীবদ্দশায় একটি বাস ও ট্রাক ছিল। ১৯৮৩ সালে ৫ ছেলে এবং ২ মেয়ে রেখে মাত্র ৪৭ বছরে মারা যান তিনি। তার মৃত্যুর পর সাংসারিক খরচ চালাতে গিয়ে ওই দুটি গাড়ি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন এরশাদ উল্লাহর স্ত্রী আলতাফের নাহার বেগম।
এরশাদ উল্লাহর বড় ছেলে হাজী নিজাম উদ্দিন স্টার লাইন গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি বর্তমানে সৌদি আরবে ব্যবসা করেন। ২য় ছেলে হাজী আলাউদ্দিন স্টার লাইন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি ফেনী পৌরসভায় মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ৩য় ছেলে জাফর উদ্দিন স্টার লাইন গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক, ৪র্থ ছেলে জামাল উদ্দিন অর্থ (ফিন্যান্স) পরিচালক, এবং ছোট ছেলে মাঈন উদ্দিন পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া এরশাদ উল্লাহর মেয়ে বিবি মরিয়ম এর স্বামী সাইদুল হক মিন্টু এবং সাহেদা আক্তার চম্পার স্বামী মাহমুদুল হক চৌধুরী মুনির স্টার লাইন গ্রুপের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
স্টার লাইন গ্রুপের পরিচালক মাঈন উদ্দিন বলেন, 'পরিবহন আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। বাবার মৃত্যুর ১১ বছর পর ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ৪টি গাড়ি দিয়ে ৪ জনের অংশীদারিত্বে ১৯৯৪ সালে ১ কোটি টাকা মূলধনে পরিবহন ব্যবসায় স্টার লাইন বাসের যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু এই রুটে এস আলম গ্রুপের একসাথে নামানো ২০টি হিনো বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে স্টার লাইন বাসের এই ব্যবসা খুব বেশিদিন টেকেনি। লোকসানের পাল্লা ভারী হওয়ায় ১৯৯৭ সালে এসে অংশীদারদের মধ্যে বাস ভাগাভাগির মাধ্যমে ব্যবসা গুটিয়ে নেয় স্টার লাইন বাস। ওই সময় স্টার লাইন গ্রুপের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাজী আলাউদ্দিনের দুটি বাস ভাগে পড়েছিল । লোকসান হওয়ায় আমার বড় ভাই হাজী নিজাম উদ্দিন পুনরায় পরিবহন ব্যবসায় বিনিয়োগে আগ্রহী ছিলেন না। পরবর্তীতে আমার মায়ের অনুরোধ তিনি এই ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন'।
তিনি আরো বলেন, '১৯৯৮ সালে সোহাগ পরিবহন থেকে পুরোনো একটি বাস ক্রয় এবং একটি বাস ভাড়া নিয়ে স্টার লাইন বাসের পুনঃযাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকে পারিবারিকভাবে গড়ে উঠা স্টার লাইন পরিবহনকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আমাদের পরিবারের সকল সদস্যের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ফেনীসহ সারা দেশে একটি বড় শিল্প গ্রুপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্টার লাইন। পরিবহন সেক্টরে নামীদামি প্রতিষ্ঠানের সাথে পাল্লা দিয়ে স্টার লাইন নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছে। বর্তমানে ঢাকা-কক্সবাজার, ঢাকা- ফেনী, ফেনী- চট্টগ্রাম, ফেনী-কক্সবাজার রুটে পরিবহন ব্যবসা পরিচালনা করছে স্টার লাইন গ্রুপ।
মাঈন উদ্দিন বলেন, 'পরিবহন ব্যবসার পুনঃযাত্রায় আমার বড় ভাই গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক জাফর উদ্দিন ৩টি নতুন বিষয় সংযোজন করলেন। প্রথমত ধুমপান মুক্ত পরিবহন সেবা, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গাড়ি ছাড়া এবং যাত্রাপথে নামাজের বিরতি। পরিবহন সেবায় এই তিনটি বিষয়ের কারণে স্টার লাইন গ্রুপের ব্যবসা বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রতিবছর গাড়ির বহরে যুক্ত হতে থাকে ৪-৫ টি গাড়ি।
তিনি আরো বলেন, স্টার লাইন গ্রুপের 'ভিশন' হচ্ছে দেশ প্রেম, সমাজ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান এবং নতুনত্ব। একটি পরিপূর্ণ পরিবহন ব্যবসা থাকতে হলে নিজস্ব বাস এর পাশাপাশি নিজস্ব টার্মিনাল, কাউন্টার, পেট্রোল পাম্প, ওয়াকর্শপ থাকতে হয়। এর সবগুলোই আছে স্টার লাইন গ্রুপের। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনীতে রয়েছে ৪টি নিজস্ব টার্মিনাল। আমাদের ৩ টি পেট্রোল পাম্প এবং ওয়ার্কশপ রয়েছে। স্টার লাইন পরিবহন সেক্টরে নিয়োজিত আছে ২ হাজার কর্মী।
সুখকর ছিল না শুরুটা
ঢাকা- চট্টগ্রাম রুটে বিভিন্ন নামীদামি পরিবহন কোম্পানীর সাথে পাল্লা দিয়ে স্টার লাইন গ্রুপের অবস্থান তৈরী করার পথ সুখকর ছিল না। রাজনৈতিক নানা অস্থিরতায় বার বার হোঁচট খেয়েছে স্টার লাইন গ্রুপের পরিবহন ব্যবসা। ২০১৪ সালে অসহযোগ আন্দোলন, টানা হরতাল অবরোধের কারণে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। ওই সময়ে ৫০টি বাসে আগুন এবং ভাংচুরের কারণে ১০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এর মধ্যে কিছু ক্ষতিপূরণ দেয় সরকার ।
ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে চার লেনের কাজ, মহিপাল ফ্লাইওভার, ফতেহপুর ফ্লাইওভারসহ বিভিন্ন ব্রিজ সংস্কারের কারণে সীমাহীন যানজটে পরিবহন ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা -চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল নিরবচ্ছিন্ন হওয়ার পর করোনার লকডাউন শুরু হয়। ফলে টানা প্রায় তিন মাস পরিবহন ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ ছিল।
করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসআর)
ফেনীতে শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করছে স্টার লাইন গ্রুপ। ফেনীতে ক্যাডেট কলেজ থাকলেও ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে ফেনীর শিক্ষার্থীরা এই কলেজে অধ্যয়নের সুযোগ পায় না। স্টার লাইন গ্রুপ ৫০ লাখ টাকা অনুদান এবং ফেনী পৌরসভার ৫০ লাখ টাকার অনুদান নিয়ে ফেনীতে গড়ে তুলেন কোচিং সেন্টার। গত ৫ বছরে এই কোচিং সেন্টারে অধ্যয়ন করে ফেনীর ১১৫ জন শিক্ষার্থী ফেনী ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হতে পেরেছে।
এছাড়া স্টার লাইন গ্রুপ প্লে থেকে এসএসসি পর্যন্ত একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল পরিচালনা করে। এতে ৪৫০ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কলেজে ৬৫০ শিক্ষার্থী এবং হেফজখানায় অধ্যয়ন করে ৩৫ শিক্ষার্থী। ফেনীর অধিবাসীদের কম মূল্যে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ফেনী-মহিপাল জিরো পয়েন্টে স্টার লাইন গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করছে ৫০ শয্যার হাসপাতাল। যেখানে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ পাবে।
শুধুমাত্র ব্যবসায় নয়, মানবিক নানা কাজে ভূমিকা রাখে স্টার লাইন গ্রুপ। ফেনীর ধর্মীয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আর্থিক অনুদান দেয় ব্যবসায়িক এই প্রতিষ্ঠানটি। করোনার লকডাউনে ৩ মাস পরিবহন সেক্টর পুরোপুরি বন্ধ থাকলেও সকল কর্মীদের শতভাগ বেতন এবং বোনাস দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বাৎসরিক ইনক্রিমেন্টও দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী। করোনাকালীন সময়ে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকার খাদ্যসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণ করেছে স্টার লাইন গ্রুপ।
মাঈন উদ্দিন আরো বলেন, আগামীতে একটি ফয়েল ফ্যাক্টরি নির্মাণের পরিকল্পনা আছে আমাদের। এছাড়া একটি পেট্রোল পাম্প ও ফেনীতে একটি ফল মার্কেট এবং কোল্ড স্টোরেজ নির্মানের পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।