টেকসই ব্যবসার জন্য পোশাক প্রস্তুতকারীদের মূল পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে: বিশেষজ্ঞরা
তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতে কাঁচামালসহ পরিবহনের বাড়তি ব্যয়ের সঙ্গে মিল রেখে বিদেশি ক্রেতারা দাম বাড়াচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসাকে টেকসই করতে পোশাকের পাঁচ পণ্যনির্ভরতা (টি-শার্ট, শার্ট, ট্রাউজার, সোয়েটার ও জ্যাকেট) থেকে বেরিয়ে ডাইভারসিফিকেশনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, নিজের পণ্য ও দক্ষতাকে ক্রেতার কাছে সঠিকভাবে উপস্থানের পরামর্শও দিয়েছেন তারা।
পোশাক শিল্প খাতের নেতারা বলেন, উৎপাদন খরচ, বিশেষ করে কাঁচামাল ও পরিবহন খরচ অনেক বেশি হলেও দেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতে বিদেশি ক্রেতারা তাদের ক্রয়মূল্য সেই অনুপাতে সংশোধন করছে না।
শুক্রবার রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে ন্যায্য মূল্য ইস্যুতে আলোচনা করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। 'বাংলাদেশ এক্সক্লুসিভ: দ্য রোড টু কম্পিটিটিভ অ্যান্ড রেজিলিয়েন্ট এক্সপোর্ট ফিউচার' শীর্ষক ওই ওয়েবিনারের আয়োজন করে এইচএসবিসির বিটিওবি প্ল্যাটফর্ম সেরাই। আরএমজি খাতকে আলোচনার কেন্দ্রে রেখে আয়োজিত ওই ওয়েবিনারে সহায়তা করে বাংলাদেশ গারমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ), বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে মিডিয়া পার্টনার ছিলো দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
বৈচিত্র্যময় পণ্যে যাওয়ার গুরুত্বের কথা স্বীকার করেন বিজিএমইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ক্লাসিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল্লাহ আজিম। তিনি বলেন, 'বিশ্বব্যাপী রপ্তানিকৃত পোশাকের ৭০ শতাংশ যেখানে ম্যানমেড ফাইবারের, সেখানে আমাদের রপ্তানিতে এর অংশ মাত্র ৩০ শতাংশ। এই পোশাকের দামও বেশি। আমরা এখন ম্যানমেড ফাইবারের পোশাক তৈরিতে সদস্যদের উৎসাহিত করছি।'
এ সময় তিনি বিদেশি ক্রেতাদের স্বচ্ছতার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, 'তারা আমাদের কাছে ওপেন কস্টিং চায়। নইলে অর্ডার দেয় না। কিন্তু তাদের বিষয়ে সামান্যতম কিছুও জানায় না।'
ওপেন কস্ট হলো কাঁচামাল ও অ্যাকসেসরিজ ক্রয়ের তথ্য ক্রেতাকে জানানো, যার উপর ভিত্তি করে ক্রেতা অর্ডার দেওয়ার জন্য দাম নির্ধারণ করে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবদুর রহিম খান বলেন, দেশের আরএমজি খাত প্রায় ৩০টি পণ্য রপ্তানি করে। 'কিন্তু এই রপ্তানির ৭০ শতাংশ আসে মাত্র পাঁচটি পণ্য থেকে। আমাদের লক্ষ্য হলো ক্রমান্বয়ে আইটেমের সংখ্যা বাড়ানো,' বলেন তিনি।
এ বিষয়ে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ম্যানমেড ফাইবার প্রচারের ব্যাপারে আপনারা আগামী বছরই একটা ভিন্ন নীতি দেখতে পাবেন।'
তিনি বলেন, পোশাক খাতকে টেকসই করতে আরএমজি পণ্যের বহুমুখীকরণের বিকল্প নেই।
বিজিএমইএর তথ্যানুসারে, ২০২০ সালের তুলনায় এ বছর এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের আরএমজি পণ্যের দাম ৫ শতাংশের বেশি কমেছে। শিল্প সংশ্লিষ্টরা মনে করেনম পণ্যের বৈচিত্র্য এই দামের চাপ কমাতে সাহায্য করবে।
বিকেএমইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলে শামীম এহসান বলেন, 'গত কয়েক মাস ধরে ক্রমাগত পোশাকের মূল কাঁচামাল কটনের দাম বাড়ছে। কন্টেইনার ব্যয়সহ সার্বিক লজিস্টিকস ব্যয় বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশ গ্রিন পোশাক কারখানায় এখন রোল মডেল, যার জন্য উদ্যোক্তাদের বাড়তি ব্যয় করতে হয়েছে।'
তিনি বলেন, এত ব্যয় বাড়া সত্ত্বেও বিদেশি ক্রেতারা সে হারে দর বাড়াচ্ছেন না।
এ সময় রানা প্লাজার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে হওয়া পোশাক খাতের জন্য বাংলাদেশ সরকারের হওয়া 'সাসটেইনেবিলিট কমপ্যাক্ট' চুক্তির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, 'সেখানে তিনটি পিলারের মধ্যে একটিতে রয়েছে ফেয়ার প্রাইস ইস্যু। কিন্তু এটি নিয়ে কোন পক্ষই কথা বলে না।'
এ প্রসঙ্গে সেরাইয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিবেক রামচন্দ্রন বলেন, 'বিশ্বব্যাপী ডিমান্ডের চেয়ে সাপ্লাই ক্যাপাসিটি বেশি। এই অ্যাক্সেস ক্যাপাসিটির কারণে ক্রেতা যেখানে কম দামে পাবে, সেখানেই যাবে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই।
'এজন্য রপ্তানিকারককে ব্যতিক্রমী চিন্তা করতে হবে। ডাইভারসিফাইড প্রোডাক্ট তৈরির পাশাপাশি নিজের সক্ষমতা ক্রেতার কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। এজন্য ডিজিটাল ব্যবস্থায় মনযোগী হতে হবে।'
তার এমন পরামর্শে একমত প্রকাশ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবদুর রহিম খান বলেন, 'বায়ার এসেই আমার দেওয়া প্রাইস অ্যাকসেপ্ট করবে, তা নয়। আমাদের এফিসিয়েন্সি বাড়ানোর মাধ্যমে প্রাইস প্রেশার কমিয়ে আনতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর মাধ্যমে কস্ট অব প্রোডাকশন কমিয়ে আনতে হবে।' এই উদ্দেশ্যে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে মনযোগী হতে হবে বলে মত দেন তিনি।
এ সময় তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর রপ্তানি সুবিধা অব্যাহত রাখতে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে (এফটিএ) সরকারের গুরুত্ব রয়েছে। অন্তত ২৪টি দেশের সঙ্গে এফটিএ এর আলোচনা চলছে।
ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাংবাদিক কুতুব উদ্দিন মোহাম্মদ জসিম।