টিকটক কেনায় শেষ মুহূর্তে বাদ পড়ল মাইক্রোসফট
চীনা অ্যাপ টিকটকের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আশঙ্কার জের ধরে টিকটক ও ওরাকল ব্যবসায়িক অংশীদার হতে যাচ্ছে, জানান সংশ্লিষ্টরা।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অ্যাপটি বিক্রি করে দেওয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধ করার দাবি তোলার পর দেশটিতে টিকটকের ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এই খবর আসে।
টিকটক ও ওরাকলের চুক্তির ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি; তবে চুক্তিটিকে সরাসরি বিক্রি বলে উল্লেখ করা হয়নি। মাইক্রোসফট বাইটড্যান্স থেকে টিকটকের যুক্তরাষ্ট্রের অংশ কিনে নেবে না- ঘোষণা দেওয়ার পরপরই খবরটি আসে।
বাইটড্যান্স ও ওরাকল এ ব্যাপারে মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি। অন্যদিকে, টিকটক এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
একটি বিতর্কিত অ্যাপ
যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশে বিপুল জনপ্রিয়তা পায় টিকটক। চীনের বাইরে টিকটকই প্রথম কোনো চীনা অ্যাপ হিসেবে এত জনপ্রিয়তা পায়।
সেন্সর টাওয়ারের তথ্যমতে, এ বছরের প্রথম তিন মাসে অ্যাপটি ৩১৫ মিলিয়ন বার ডাউনলোড করা হয়, যা ত্রৈমাসিক হিসেবে অন্য যেকোনো অ্যাপের চেয়ে বেশি।
তবে ট্রাম্পসহ আরও কয়জন মার্কিন রাজনীতিবিদ মনে করেন, অ্যাপটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ; কারণ বেইজিং গুপ্তচরবৃত্তির অস্ত্র হিসেবে এটি ব্যবহার করতে পারে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা প্রকাশ করে, অ্যাপটি মার্কিন নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত হতে পারে কিংবা চীনা সরকারের জন্য সংবেদনশীল বিবেচিত তথ্য সেন্সর করতে পারে।
টিকটক এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানায়, তাদের তথ্যকেন্দ্র চীনের বাইরে অবস্থিত; কোনো তথ্যই চীন সরকারের অধীনে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক বন্ধ করার নির্ধারিত সময়ের কিছুদিন পূর্বেই ওরাকলের সঙ্গে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
গত ৬ আগস্ট ট্রাম্পের স্বাক্ষরিত প্রশাসনিক আদেশ অনুযায়ী, টিকটক কোন ধরনের ব্যবসায়িক লেনদেন দেশটিতে করতে পারবে না- তা ২০ সেপ্টেম্বরের পর জানানো হবে।
ওরাকলের সঙ্গে টিকটকের এই ব্যাবসায়িক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে দেশটিতে অ্যাপটির নিষেধাজ্ঞা এড়ানো যাবে কি না, এটি এখনো স্পষ্ট নয়। নিষেধাজ্ঞা কিভাবে বাস্তবায়িত হবে, এ ব্যাপারে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে প্রশাসনিক আদেশের ভাষা ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্য।
আরেকটি প্রশাসনিক আদেশে ট্রাম্প জানান, ক্রেতা খোঁজার জন্য টিকটকের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত সময় আছে।
৬ আগস্টের প্রশাসনিক আদেশকে স্থগিত করে এই অস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিচারিক সিদ্ধান্ত চেয়ে ফেডারেল কোর্টে মামলা করেছে টিকটকের একজন কর্মকর্তা। এই আবেদনের শুনানির তারিখ আগামী মঙ্গলবার। আদেশগুলোর একটিকে গভীরভাবে রাজনৈতিক উল্লেখ করে ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে টিকটক।
চুক্তির প্রকৃতি
ওরাকল ও টিকটকের মধ্যকার এই চুক্তির ব্যাপারে এখনো বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে ইতোপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি এ ব্যাপারে মানদণ্ড নির্ণয়ে পরিমাপক হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৩ সালে জাপানি প্রযুক্তি সংস্থা সফটব্যাংক স্প্রিন্টের ৭৮ শতাংশ মালিকানা পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠান দুটি জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত কয়েকটি শর্তে একমত হয়। জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে দেখভালের জন্য স্প্রিন্টের সদস্য পরিষদে নতুন সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়। কিছু বিষয়ের লেনদেনের পর্যালোচনা ও ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয় মার্কিন প্রতিরক্ষা, জাস্টিস ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগকে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেমস লেউইস জানান, টিকটক ও ওরাকলের বিষয়টির কেন্দ্রবিন্দু হবে তদারকি, স্বচ্ছতা ও মার্কিন নাগরিকদের প্রাপ্ত তথ্য কী করছে, সে ব্যাপারে।
সফটব্যাংক-স্প্রিন্ট চুক্তির একজন উপদেষ্টা ছিলেন লেউইস। তিনি আরও জানান, বাইটড্যান্স ও টিকটকের সম্পর্কের মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ হতে পারে এ কাজে। বাইটড্যান্সের তথ্য প্রাপ্তির ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা কিংবা প্রতিষ্ঠানের সদস্য পরিষদে অনুমোদিত মার্কিন সদস্য নিয়োগ দেওয়াও এই চুক্তির অংশ হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কমিটি অন ফরেইন ইনভেস্টমেন্টের প্রাক্তন সদস্য ও বারকেলি রিসার্চ গ্রুপের অংশীদার হ্যারি ব্রডম্যান জানান, এই চুক্তির ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছানো গেলেও, ওরাকল ও টিকটকের চুক্তির ব্যাপারটি এখনো বেশ জটিল।
নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে ঘুরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার উত্তেজনা দিনদিন বাড়ছে। টিকটক থেকে শুরু করে হুয়াওয়ে, টেনসেন্টের উইচ্যাটসহ বিভিন্ন চীনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ট্রাম্প জাতীয় নিরাপত্তার হুমকির অভিযোগ এনেছেন।
গত সোমবার চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম জানায়, বাইটড্যান্স টিকটকের যুক্তরাষ্ট্রের অংশ মাইক্রোসফট কিংবা ওরাকলের কাছে বিক্রি করবে না।
এই চুক্তির ব্যাপারে বেইংজিং ভবিষ্যতে কী নির্ধারণ করে দিতে পারবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। নির্দিষ্ট কিছু প্রযুক্তি বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বিক্রির ব্যাপারের নিয়মনীতি সংশোধন করে দেশটি গত মাসে। ডাটা প্রসেসিং, স্পিচ ও টেক্সট রিকগনিশনের মতো নতুন তালিকার উল্লেখিত অনেক প্রযুক্তি টিকটকেও ব্যবহৃত হয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
নতুন এই আদেশে টিকটক ও বাইটড্যান্সের নাম উল্লেখ না থাকলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন এই আইন অনুযায়ী কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে টিকটক বিক্রির পূর্বে সরকারি অনুমতি নিতে হবে বাইটড্যান্সের।
সোমবারে একটি নিয়মিত সাংবাদিক সম্মেলনে ওরাকলের সঙ্গে এই চুক্তির ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে মন্তব্য করেনি চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে, টিকটকের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারে ক্যাম্পেইনের সমালোচনা করা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াঙ ওয়েনবিন বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো দেশের প্রতিষ্ঠান কোনো খাতে ব্যাপক উন্নতি করে তাদের ছাড়িয়ে গেলে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রমাণবিহীন জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে অযৌক্তিকভাবে দমন করে। এসব প্রতিষ্ঠানের আইনসঙ্গত অধিকার ও স্বার্থ বজায় রাখতে আমরা পূর্ণ সহায়তা করব।'
- সূত্র: সিএনএন