ঝুঁকির মুখে এলপিজি শিল্প
বর্তমান সরকার লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম নির্ধারণ করে দেওয়ায় এলপিজি খাতে একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে। একইসঙ্গে বাজারে টিকে থাকার লড়াইও ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠেছে।
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ এনার্জি শক্তি নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিইআরসি) একটি আদেশ জারির মাধ্যমে বেসরকারি খাতে এলপিজির মূল্য নির্ধারণ ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেয়।
গত সপ্তাহে দেওয়া বিইআরসি'র নির্দেশ অনুযায়ী, বেসরকারি অপারেটরের মাধ্যমে বিক্রিত ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের খুচরা মূল্য ধরা হয়েছে ৯৭৫ টাকা। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত এলপি গ্যাসের ১২ দশমিক ৫ কেজির সিলিন্ডারের মূল্য ৫৯১ টাকা ধার্য করা হয়।
নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিভিন্ন আকারের সিলিন্ডারে এলপিজির মূল্যও নির্ধারণ করে দিয়েছে। এখানে প্রতি কেজি গ্যাসের মূল্য ধরা হয়েছে ৮১ দশমিক ৩০ টাকা।
কিন্তু এলপিজি বিনিয়োগকারী ও অপারেটররা মনে করছেন, এই মূল্য নির্ধারণ তাদের ব্যবসা খাতের জন্য অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত একটি সিদ্ধান্ত। কারণ এর আগে তারা প্রতি কেজি গ্যাস বিক্রি করে আসছিলেন ৮৭.৫ থেকে ৯১.৬৬ টাকায়।
এছাড়া বিইআরসি সিলিন্ডার, সরবরাহ ব্যয় ও অপারেটরের খরচও ধরেনি বলে তারা ভবিষ্যতে লোকসানের সম্মুখীন হবেন বলে আশঙ্কা করছেন এই শিল্পের কর্তাব্যক্তিরা। বাজারে অনেক বেশি প্রতিযোগিতা চলে আসায়ইতোমধ্যেই লোকসান গুনছেন বলেও দাবি তাদের।
নতুন এই মূল্যের নমুনার ফলে কিছু প্রতিষ্ঠান নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবে কিংবা সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারে বলেও দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান তারা।
কয়েকজন এলপিজি অপারেটর জানান, বিইআরসির বেঁধে দেওয়া দামে বিক্রি করতে গিয়ে তারা প্রতি ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারে ১০০ টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তাদের ভাষ্যে, নিয়ন্ত্রণ কমিশনের আদেশ আসার আগে থেকেই তারা ২৫-৫০ টাকা লোকসান দিয়েই গ্যাস বিক্রি করছিলেন।
ক্ষতির সম্মুখীন হবার পরেও বড় কোম্পানিগুলোর অধীনে থাকা বহু অপারেটর নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। তবে স্টেকহোল্ডারদের মতে, কোনো প্রতিষ্ঠান যদি কেবলমাত্র এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি করে এই খাতে টিকে থাকতে চায়, তাহলে অচিরেই তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে।
বাংলাদেশ এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট আজম জে চৌধুরী বলেন, '৮-৫টি অপারেটর বাদে বাকি সবাই লোকসান মাথায় নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে। নতুন মূল্য নির্ধারণী মেনে চলতে গেলে এই খাতের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়বে।'
ওমেরা এলপিজি'র মালিক, ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম আরও জানান, সৌদি আরামকো'র মূল্য ঠিকই আছে, কিন্তু বিইআরসি মূল্য নির্ধারণে কিছু গুরত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে গেছে।
অপারেটররা কেন লোকসান গুনছে?
বিগত দুই দশকে এলপিজি খাতে লাইসেন্স পেয়েছে ৫৪টি কোম্পানি। তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ৩২ হাজার কোটি টাকা। এসব লাইসেন্সধারীর মধ্য থেকে ২৮টি অপারেটর বর্তমানে সক্রিয়ভাবে বাজারে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের বার্ষিক এলপিজি সরবরাহের পরিমাণ ২ মিলিয়ন টন।
কিন্তু বিইআরসি ও শিল্পের ডেটা অনুযায়ী, বর্তমানে বার্ষিক চাহিদা ১ দশমিক ২ মিলিয়ন টন।
গৃহস্থালী ব্যবহার থেকে শুরু করে পরিবহণ খাত পর্যন্ত এর নানামুখী ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় বার্ষিক ১০ শতাংশ হারে এই জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেখানে এলপিজি খাতের এই বিনিয়োগ প্রশংসার দাবিদার, সেখানে তাদের দেখতে হচ্ছে বিপরীত চিত্র।
প্রচণ্ড পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন এলপিজি বিনিয়োগকারীরা। মফস্বল ও গ্রামীণ এলাকাগুলোতে অনেকেই এখনো প্রথাগত রান্নার পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে গ্যাসে রান্না শুরু না করায় গ্যাসের চাহিদাও কিছুটা কম।
এই শিল্পের কর্তাব্যক্তিরা জানান, বর্তমান চাহিদার তুলনায় তাদের এখনো আরও ৫০ শতাংশ বেশি গ্যাস সরবরাহ করার ক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া নতুন নতুন কোম্পানিগুলো ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য বিশেষ মূল্যছাড়ে এলপিজি সরবরাহ করছে।
উদাহরণস্বরূপ, একটি খালি সিলিন্ডারের মূল্য ২,০০০ থেকে ২,৪০০ টাকা। অপারেটররা প্রথমবার কেনার সময় ক্রেতার কাছ থেকে সিলিন্ডারসহ গ্যাসের দাম রাখত। কিন্তু এখন অপারেটরদের একটি সিলিন্ডারের জন্য সর্বনিম্ন ৭০০ টাকা রাখতে হচ্ছে নিরাপত্তা আমানত হিসেবে এবং বাকি টাকাটা বিনিয়োগ হিসেবে রাখা হচ্ছে।
নতুন অপারেটররা প্রাথমিকভাবে এই কার্যক্রম শুরু করে এবং পরবর্তীকালে পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত অপারেটররাও তাদের ক্রেতাদের কাছে সর্বনিম্ন দামে সিলিন্ডার সরবরাহ করতে শুরু করে। এর ফলে কোম্পানিকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
এলপিজি অপারেটররা কী বলছেন?
২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করা জেএমআই এলপিজি এই খাতের নব্য বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি এবং গোড়া থেকেই তারা ক্ষতি স্বীকার করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
জেএমআই এলপিজি'র ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সরদার জাহাঙ্গীর বলেন, 'আমাদের মতো নতুন অপারেটররাই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। একটা সিলিন্ডারের দাম ২২০০ টাকা, কিন্তু আমরা ভোক্তার থেকে পাচ্ছি ৭০০ টাকা। বাকি ১৫০০ টাকা ভর্তুকি দিচ্ছি, তাই আমাদের লোকসান হচ্ছে।'
তিনি আরও জানান, উৎপাদন, বণ্টন ও খুচরা পর্যায়ে কর প্রদানের বিষয়টিও এলপিজি অপারেটরদের লোকসানের একটি কারণ।
বসুন্ধরা এলপি গ্যাস লিমিটেডের হেড অব সেলস, ইঞ্জিনিয়ার জাকারিয়া জালালের মতে, বিনিয়োগকারীদের সুবিধা-অসুবিধা না বুঝেই নতুন মূল্য নির্ধারণী আদেশ দেওয়া হয়েছে।
এলপিজি খাতের ভোক্তা পর্যায়ে নতুন মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে ৮টি বিষয় বিবেচনা করেছে বিইআরসি, তা হলো- নিম্ন কাঁচামাল ব্যয়, জাহাজ ও ট্রেডারদের জন্য প্রিমিয়াম চার্জ, আমদানি সমতা মূল্য, সংরক্ষণ ও বোতলজাতকরণ ব্যয়, ভ্যাট, বণ্টন খরচ, খুচরা বিক্রেতার খরচ এবং অন্যান্য ব্যয়।
অপারেটররা বলছেন, সিলিন্ডারের দাম একটি বড় অর্থনৈতিক দিক যা নিয়ন্ত্রণ কমিশনের মূল্য নির্ধারণীতে নেই।
বাংলাদেশ এলপিজি অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট আজম জে চৌধুরী বলেন, 'অন্য যেসব বিষয় রয়েছে, যেমন- অপারেটরদের ব্যয় ও সিলিন্ডার সরবরাহের মূল্য, এগুলোও বিইআরসির নির্দেশাবলিতে নেই।'
যমুনা এলপিজি'র পরিচালক ইয়াসিন আরাফাত জানালেন, এলপিজি খাতের সঙ্গে আরও অনেক অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত।
'এটা শুধুমাত্র গ্যাসের দামের ব্যাপার নয়। সিলিন্ডারের দাম, ডেলিভারি ব্যয় ও অপারেটরের চার্জও মূল্যতালিকায় সংযোজন করা উচিত। তারপরও বেশিরভাগ কোম্পানি এখন প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে সিলিন্ডারের দামে ভর্তুকি দিচ্ছে', বলেন আরাফাত।
বিইআরসি তাদের নির্দেশনামায় সিলিন্ডারের খরচ ধরেনি জানিয়ে আরাফাত আরও বলেন, যদি এই নির্দেশ সংশোধন করা না হয়, তাহলে কিছু কোম্পানিকে সম্মিলিত হয়ে তা অর্জন করতে হবে।