জলপথে পণ্য রপ্তানিতে যেভাবে বেড়েছে খরচ
বৈশ্বিক মহামারি করোনার সংক্রমণ শুরুর আগে একটি বিশ ফুটের কন্টেইনার (টিইইউ) পণ্য আমেরিকায় পাঠাতে ব্যয় হতো তিন হাজার মার্কিন ডলার। এক বছরের ব্যবধানে এই ব্যয় বেড়েছে ১৮ হাজার মার্কিন ডলারে।
শুধু আমেরিকায় নয় ইউরোপেও একই আকারের কন্টেইনার পাঠাতে খরচ হতো ২৫০০ মার্কিন ডলার। বর্তমানে এই ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার মার্কিন ডলারে। সে হিসেবে প্রতি টিইইউ রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনারে গড়ে প্রায় ১২ হাজার ৫০০ ইউএস ডলার ফ্রেইট চার্জ (জলপথে পণ্য পরিবহন খরচ) বৃদ্ধি পেয়েছে।
কন্টেইনারের বর্ধিত চার্জের বিষয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এ তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ।
করোনার কারণে আন্তর্জাতিক সমুদ্র পথে জাহাজ চলাচল কমে যাওয়া, কন্টেইনার সংকটসহ সাপ্লাই চেইনে বিপর্যয়ের কারণে ৪'শ থেকে ৫'শ শতাংশ ফ্রেইট চার্জ বেড়েছে। ফ্রেইট নিয়ে নির্ধারিত কোন ট্যারিফ না থাকায় যে যার ইচ্ছে মতো ভাড়া আদায় করছে বলে জানান সৈয়দ আরিফ।
পণ্য রপ্তানিতে কন্টেইনার ভাড়ার এ তথ্যের বিষয়ে একমত পোষণ করেন বিজিএমএইএ'র ভাইস প্রেসিডেন্ট রাকিবুল আলম চৌধুরীসহ একাধিক পোশাক রপ্তানিকারক।
ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারন্যাশনাল শিপিংয়ের খরচ বর্তমানে যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। সাংহাই থেকে রটারডাম পর্যন্ত একটি ৪০-ফুট স্টিলের কন্টেইনার পরিবহনের জন্য এখন রেকর্ড ১০ হাজার ৫২২ ডলার হচ্ছে, যা পাঁচ বছরের গড় খরচের চেয়ে ৫৪৭ শতাংশ বেশি। চীন এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে শিপিং খরচ বেড়েছে ৩৫০ শতাংশ।
নতুন কন্টেইনারের দামও গত বছরের থেকে দ্বিগুণ হয়ে ইউনিট প্রতি সাড়ে ৩ হাজার ডলার হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত শিপিং খরচ বর্তমান স্তরেই থাকবে।
পণ্য পরিবহনের এই উচ্চ খরচ ছাড়াও বন্দরগুলোতে আগের চেয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে চালানগুলোকে।
এদিকে পোশাক রপ্তানিতে কন্টেইনার ভাড়া বাড়ার পাশাপাশি পোশাক রপ্তানিকারকদের নতুন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জ্বালানি তেলের মুল্য বৃ্দ্ধি। এতে একদিকে অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যয় বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে গত ৪ নভেম্বর থেকে বেসরকারি ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোতে (আইসিডি) ২৩ শতাংশ চার্জ বৃদ্ধিতে পোশাক রপ্তানিকারকরা আরো সংকটে পড়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে আইসিডির বর্ধিত চার্জ প্রত্যহারের দাবি জানিয়ে গত ১০ নভেম্বর বিজিএমইএ'র ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো এসোসিয়েশনের (বিকডা) সভাপতিকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, একতরফাভাবে হঠাৎ বিকডা কর্তৃক বিভিন্ন চার্জ বৃদ্ধির ফলে তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি আদেশগুলো কার্যকর করা কঠিন হয়ে পড়বে।
এই চিঠির জবাবে ১৪ নভেম্বর আইসিডি মালিকদের সংগঠন বিকডার সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বিজিএমইএ সভাপতিকে একটি চিঠি দিয়েছেন।
সেখানে উল্লেখ করা হয়, নিজেদের তহবিল হতে ভর্তুকি দিয়ে ব্যবসা করা আইসিডিগুলোর পক্ষে সম্ভব নয়। ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বেসরকারি আইসিডিসমূহের অপারেশন ব্যয় বৃদ্ধিকে পুষিয়ে নেবার জন্য বেসরকারি আইসিডিসমূহের সংশ্লিষ্ট মাশুলসমূহকে ২৩ শতাংশ সমন্বয় করা হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, "এটি মূল্যবৃদ্ধি নয়, এটি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সাথে বেসরকারি আইসিডির মাশুলের সমন্বয়, যা অপরিহার্য। এই ব্যয় বৃদ্ধিকে নিজেদের তহবিল হতে ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করে ব্যবসা করা আইসিডিসমূহের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভবপর নয়।"
বিজিএমইএর চিঠির জবাবে বিকডা সভাপতির দেওয়া চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, "রপ্তানি খাতে ট্রাক/কাভার্ড ভ্যানের ভাড়া বৃদ্ধির কারণে বাৎসরিক ব্যয় বৃদ্ধি ২৮৭ কোটি টাকা। ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে রপ্তানিকারকগণের ফ্যাক্টরি হতে বেসরকারি আইসিডি পর্যন্ত রপ্তানি পণ্যের পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩০%। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির পরে এই মূল্যবৃদ্ধি কার্যকর করা হয়েছে।"
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, আগামী এক বছরে রপ্তানি পণ্যের ফ্যাক্টরি হতে বেসরকারি আইসিডি পর্যন্ত মোট ভাড়া বৃদ্ধি পাবে প্রায় ২৮৭ কোটি টাকা। করোনা মহামারীতে শিপিং লাইনসমূহের ফ্রেইট চার্জ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪০০ শতাংশ হতে ৫০০ শতাংশ। বাংলাদেশের বিগত ২০২০-২১ অর্থ বছরের রপ্তানি ভলিউমের বিবেচনায় এক বছরে মোট ফ্রেইট চার্জ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪২৬ দশমিক ৩ কোটি মার্কিন ডলার বা ৩৬ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা।
চিঠিতে বিকডার সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান আরও বলেন, "বেসরকারি আইসিডির মাশুল সমন্বয়ের কারণে যখন সামগ্রিক রপ্তানি পণ্যের বিপরীতে বাৎসরিক ব্যয় ৫৫ কোটি টাকা বৃদ্ধি পায়, তখন ট্যারিফ কমিটি, সরকারি অনুমোদন ইত্যাদি বিষয় আপনাদের মূখ্য বিবেচনায় চলে আসে। বেসরকারি আইসিডির রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিং চার্জের বড় অংশটাও ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার তথা বিদেশী ক্রেতাগণ পরিশোধ করেন। তারপরও বেসরকারি আইসিডির এই ৫৫ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি আলোচনা-সমালাচনার কেন্দ্রবিন্দুতে । বেসরকারি আইসিডি খাতের প্রতি এই বিমাতাসুলভ আচরণের কারণ আমাদের বোধগম্য নয়।"
সংশ্লিষ্টদের প্রতি প্রশ্ন তুলে তিনি চিঠিতে বলেন, "বেসরকারি আইসিডিগুলো দেশের ৩৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের প্রায় ১০০% রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিং করে, ২৫% আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিং করে এবং সারাবছর চট্টগ্রাম বন্দরের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরকে চালু রেখে সকলের এই নেতিবাচক মনোভাবের শিকার কেন?"
এ বিষয়ে বিজিএমইএ'র ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে করোনা ভাইরাসের প্রভাব বিশ্বব্যাপী হ্রাস পাওয়ার ফলে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের ক্রেতারা আমাদের দেশে যেসব রপ্তানি আদেশ প্রেরণ করছে তা রপ্তানিকারকগণ বর্তমানে কার্যকর ব্যবসায়িক খরচের ওপর ভিত্তি করে সম্পাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। একতরফাভাবে হঠাৎ বিকডা কর্তৃক বিভিন্ন চার্জ বৃদ্ধির ফলে তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি আদেশগুলো কার্যকর করা কঠিন হয়ে পড়বে।
বিজিএমইএ'র একজন সাবেক সহ সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, করোনা মাহামারিতে ফ্রেইট চার্জ অস্বাভাবিক বেড়েছে এটা সঠিক। এই সংকট সাময়িক। কিন্তু এসব অজুহত দেখিয়ে আইসিডিতে ২৩ শতাংশ চার্জ বৃদ্ধি কোনভাবেই কাম্য হতে পারেনা।
দেশের ১৯ টি বেসরকারি আইসিডিতে শতভাগ রপ্তানি পণ্য কন্টেইনার বোঝাই করে জাহাজীকরণের জন্য বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়া খাদ্য পণ্যসহ ৩৭ ধরনের আমাদনি পণ্য জাহাজ থেকে বন্দরে নামানোর জন্য সেগুলো ডিপোতে এনে খালাস করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ১ থেকে ২৬ কিলোমিটারের মধ্যে এসব আইসিডির অবস্থান।