চট্টগ্রামে লকডাউনের আগে নগদ টাকা তুলতে ব্যাংকে গ্রাহকদের ভিড়
করোনাভাইরাস সংক্রমণের উর্ধ্বগতি রুখতে সোমবার (৫ এপ্রিল) থেকে সারাদেশে সপ্তাহব্যাপী লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে অন্যান্য জরুরি সেবার আওতায় খোলা থাকছে ব্যাংকও। তবু লকডাউনের আগের দিন হিসেবে আজ রোববার নগদ টাকা উত্তোলনে চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যাংকের শাখাগুলোতে ভিড় করছেন গ্রাহকরা। এতে ব্যাংকগুলোতে অসম্ভব হয়ে পড়ছে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা।
এ পরিস্থিতিতে ভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকিতে পড়ছেন গ্রাহকদের পাশাপাশি ব্যাংককর্মীরাও। স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ছে বাণিজ্যিক এলাকার ব্যাংক কর্মকর্তাদের।
সরেজমিনে নগরীর দিদার মার্কেট এলাকায় অবস্থিত সোনালী ব্যাংক সিরাজউদ্দৌলা রোড শাখায় গিয়ে দেখে গেছে, ব্যাংকটির শাখা থেকে দিদার মার্কেটের মোড় পর্যন্ত পৌঁছেছে গ্রাহকদের লাইন। লাইনে দাড়িয়ে আছেন প্রায় ২০০ নারী-পুরুষ।
লাইনে দাঁড়ানো ডা. নারায়ন চৌধুরী বলেন, 'সকাল ১০টার আগে ব্যাংকে এসেছি নগদ টাকা উত্তোলন করতে। এখন সময় ১১ টা। অর্থাৎ এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও এখনো ব্যাংকে ঢুকতে পারিনি। এখনো আমার সামনে ৪০/৫০ জন গ্রাহক দাঁড়িয়ে আছেন। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে- টাকা তুলতে আরও এক ঘণ্টা সময় লাগবে।'
লকডাউনে ব্যাংক খোলা থাকবে, তারপরও কেন করোনা সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা উত্তোলন করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে মাস্টারপুল এলাকার বাসিন্দা ফাহমিদা সুলতানা বলেন, 'যেহেতু দিন দিন সংক্রমণ বাড়ছে, তাই চাইছি একসাথে কয়েক দিনের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে নেব। তাই নগদ টাকা প্রয়োজন। তাছাড়া লকডাউনে যেকোনো সময় নগদ টাকার প্রয়োজন হতে পারে। তাই ঝুঁকির মধ্যেও লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা তুলতে হচ্ছে।'
নগরীর চকবাজার এলাকায় ইসলামী ব্যাংকে গিয়েও গ্রাহকদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত নগদ টাকা তুলতে ব্যাংকে ভিড় করছেন গ্রাহকরা। এমনকি দীর্ঘমেয়াদি লকডাউনের আশঙ্কা থেকেও নগদ টাকা তোলার এই প্রবণতা বেড়েছে। ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংকে যাচ্ছেন গ্রাহকরা।
তবে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, গ্রাহকদের এত চাপ যে, সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা যাচ্ছে না। এতে ব্যাংকারদের পাশাপাশি যারা ব্যাংকে আসছেন, সবাই ঝুঁকিতে পড়ছেন। সবার নিরাপত্তার স্বার্থে করপোরেট শাখা এবং আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে সম্পৃক্ত (এডি ব্রাঞ্চ) শাখা ছাড়া বাকি শাখাগুলো বন্ধ রাখার দাবি জানিয়েছেন বেশিরভাগ ব্যাংক কর্মকর্তা।
চট্টগ্রামের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদে গিয়ে দেখা যায়, ব্যাংকের শাখাগুলোর সামনে গ্রাহকদের লাইন ব্যাংকের মূল ফটক থেকে পাশের সড়কের বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত।
আগ্রাবাদ শেখ মুজিব রোডে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা। ব্যাংকটি ভবনের দোতলায় হলেও গতকাল গ্রাহকদের লাইন চলে গেছে বারেক বিল্ডিং মোড়ের কাছে কেএসআরএম ভবন পর্যন্ত। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ব্যাংকটির কার্যালয়ের ফ্লোরে গোল চিহ্ন এঁকে দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। নিরাপত্তা কর্মীরাও এটি রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু ব্যাংকের বাইরে গ্রাহকরা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে থাকছেন। অনেকের মুখে মাস্কও নেই।
শাখা ব্যবস্থাপক ও ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মিয়া মো. বরকত উল্লাহ বলেন, 'করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে আমরা প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিয়েছি। কর্মকর্তাদের মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও সামাজিক দূরত্ব রক্ষার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের প্রবেশমুখে গ্রাহকদের জুতা জীবাণুমুক্ত করা এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এত বেশি গ্রাহকের আনোগোনা যে, সামাজিক দূরত্ব রক্ষায় আমরা হিমশিম খাচ্ছি।'
শাখাটির হিসাবমতে, রোববার দুপুর পর্যন্ত শাখাটিতে ৫০০-এর বেশি গ্রাহক নগদ লেনদেন করেছেন। এছাড়া আমদানি-রপ্তানি, ডিপিএস, সঞ্চয়পত্র, রেমিট্যান্স সম্পর্কিত কমপক্ষে আরও ২০০ গ্রাহক ব্যাংকে এসেছেন। এমন সংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাবের মধ্যে এত বেশি গ্রাহক সামলানো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলেই মনে করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।
একই এলাকায় জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের বিপরীতে রয়েছে ব্যাংক এশিয়া আগ্রাবাদ শাখা। এই শাখায় গতকাল দুপুর পর্যন্ত নগদ লেনদেন হয়েছে সাড়ে তিনশর বেশি। এছাড়া এলসি, পে-অর্ডার, সঞ্চয়পত্র ও রেমিট্যান্সসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৫০০-এর বেশি গ্রাহক লেনদেন করেছেন।
শাখা ব্যবস্থাপক ও ব্যাংক এশিয়ার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. জাহাঙ্গির আলম বলেন, 'নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিয়েছি। এরপরও ব্যাংক কর্মকর্তা ও গ্রাহকদের সংক্রমণ থেকে বাঁচানো নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।'
শুধু আগ্রাবাদ নয়, রোববারের ব্যাংকিং লেনদেন নিয়ে এভাবে বেশি উৎকণ্ঠায় রয়েছেন বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ, জুবলী রোড ও স্টেশন রোড, কদমতলী, পাহাড়তলীসহ বাণিজ্যিক এলাকার ব্যাংক কর্মকর্তারা।
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবি) খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক এরফানুল ইসলাম বলেন, 'ভোগপণ্য বিকিকিনি ও আমদানি-রপ্তানির জন্য খাতুনগঞ্জের প্রায় সব ব্যাংকেই ভিড়। কিন্তু খাতুনগঞ্জের পরিবেশ খুবই ঘিঞ্জি। এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি পণ্য আনা-নেওয়া করছে। বাজারে আসছে বিভিন্ন এলাকার মানুষ। ভ্রাম্যমাণ এই ক্রেতাসহ স্থানীয় ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন ব্যাংকে লেনদেন করছেন। এই সময়ে ব্যাংক খোলা রেখে লেনদেন করা মনে হচ্ছে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছি।'
তিনি বলেন, 'গ্রাহকদের সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে আমরা নিয়ম মেনে লাইনে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করছি। কিন্তু খাতুনগঞ্জের সড়কগুলো এত সংকীর্ণ এবং ব্যস্ত এখানে তা মানা খুবই কঠিন হয়ে পড়ছে।'