চট্টগ্রামে খেলাপি ঋণের ৪১ শতাংশই ভোগপণ্য খাতে
চট্টগ্রামে ভোগ্যপণ্য, ইস্পাত-শিপব্রেকিং, পোষাক, কৃষি, আবাসনসহ বিভিন্ন খাতে ঋণ সুবিধা দিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এই পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে গত আট বছরে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে। তবে এই ঋণের প্রায় ৪১ শতাংশই খেলাপি হয়েছে ভোগ্যপণ্য খাতে।
ওয়ান ইলেভেনে ব্যবসায়ীদের আমদানিকৃত দামের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের দামের উত্থান-পতন, এখনো পর্যন্ত গতানুগতিক পদ্ধতিতে ব্যবসা পরিচালনা, করপোরেট সংস্কৃতির বিকাশ না হওয়া, লেনদেনের পর বাজার থেকে ব্যবসায়ী গা ঢাকা দেওয়ায় এই খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বছর বছর বাড়ছে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ব্যবসার নামে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও ভোগ বিলাসের অভিযোগ রয়েছে এই খাতের ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে।
ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চকবাজার শাখার ব্যবস্থাপক শাহাদত হোসাইন। দীর্ঘদিন ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জের ন্যাশনাল ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব ছিলেন। এই কর্মকর্তা বলেন, 'এখনো খাতুনগঞ্জ সারা দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার। এক সময় এই বাজারে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে সওদাগররা শত শত কোটি টাকার লেনদেন করতো। বিশ্বাসের উপর ব্যাংকগুলোও সহজে আমদানি সুবিধাসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ঋণ সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে আস্থার সেই জায়গায় ফাটল ধরেছে। বহু ব্যবসায়ী ব্যাংক ও পাওনাদারদের টাকা না দিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। কিছু ব্যবসায়ী ব্যাংকের টাকা দিয়ে ব্যবসা করেছে ঠিকই। কিন্তু ব্যাংকের ঋণ শোধ না করে সেই টাকায় জমি কিনেছে। কিংবা ভোগ বিলাস করেছে'।
চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত আট বছরে (২০১৩-২০২০) চট্টগ্রামে খেলাপি ঋণের পরিমান দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। এরমধ্যে ভোগ্যপণ্য খাতে খেলাপি ঋণের পরিমান ১৪ হাজার কোটি টাকা। বছর বছর ঋণের বোঝা বাড়লেও গত সাত-আট বছর ধরে অনেক ব্যবসায়ী বাজার থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন। কোনো কোনো ব্যবসায়ী ব্যবসায় থাকলেও বছরের পর বছর ঋণ শোধ করছে না। এতে এই পাওনা আদায়ে দুঃশ্চিন্তায় পাওনাদার ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এমইবি
ব্যাংকঋণ শোধ করতে না পারায় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের তালিকায় প্রথম আলোচনায় আসে এমইবি গ্রুপের (মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্স) নাম। ১৯৪৬ সালে ব্যবসা শুরু করা চট্টগ্রামের এ বনেদি শিল্প গ্রুপের কাঁধে এখন ১৫ ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা ঋণের বোঝা। যেই ঋণের প্রায় পুরোটাই এখন খেলাপি হয়ে গেছে। ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে সংসদে প্রকাশ করা খেলাপি তালিকায়ও শীর্ষে ছিল এমইবি গ্রুপ।
চট্টগ্রামের এই বনেদি গ্রুপ ভোগ্যপণ্যের মাধ্যমে ব্যবসায় আসে। এরপর স্বাধীনতার আগে-পরে দেশের ভোগ্য পণ্য ব্যবসায় নেতৃত্ব দেয় গ্রুপটি। এমনকি স্বাধীনতা পরবর্তী দেশে বহুজাতিক কোম্পানি লিভার ব্রাদার্সের (ইউনিলিভার) দূ্রবস্থায় হাল ধরে ইলিয়াছ ব্রাদার্স। এরপর এদেশের ইউনিলিভারের প্রধান পরিবেশক হয়ে ব্যবসা করে প্রায় তিন যুগ। পরে ইউনিলিভারের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলে মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্স। এরমধ্যে দাদা সয়াবিন তেল, ড্রিংকিং ওয়াটার, আইসি কোলা, গ্লাস, নিটিংসহ একাধিক ব্যবসা শুরু করে গ্রুপটি।
কিন্তু ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় অনিয়ন্ত্রিত বিনিয়োগ ও পারিবারিক দ্বিধাবিভক্তির কারণে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে পড়ে এক সময়ের দেশের প্রথম সারির ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। এক সময় এক ডজনেরও বেশি প্রতিষ্ঠান থাকলেও বর্তমানে গ্রুপটির সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।
পাওনাদের ব্যাংকের কর্মকর্তা ও গ্রুপটির পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ব্যবসায় লোকসানের পাশাপাশি কর্ণধারদের পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে গ্রুপটির আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রথম দিকে মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন তার অপর ভাই মোহাম্মদ হোসেনকে নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু পরবর্তীতে গ্রুপটির মালিকানায় আসে দুই ভাইয়ের সন্তান। তাদের সন্তানদের মধ্যে ব্যবসায়িক মনোভাব ছিল কম। এছাড়া সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে গ্রুপটির কর্ণধারদের দুই ভাইয়ের সন্তানরা আলাদা হয়ে পড়ে। বিশেষ করে মোহাম্মদ ইলিয়াছের বড় ছেলে মোহাম্মদ শামসুল আলম ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন নিয়ে সংসদ নির্বাচন করে। পরবর্তী সময়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। ব্যবসায় সময় দেয়ার চেয়ে রাজনীতিই প্রধান হয়ে উঠে। এরপর ব্যবসায় হাল ধরার জন্য যোগ্য উত্তরসূরী না থাকায় গ্রুপটির বড় লোকসান হয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এই দুরবস্থায় গত কয়েক বছর আগে গ্রুপটির হাল ধরে প্রতিষ্ঠাতা মোাহম্মদ ইলিয়াছের নাতি শোয়েব রিয়াদ। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটিকে আবারো ঘুরে দাঁড় করানোর জন্য চেষ্টা করছেন এই তরুণ উদ্যোক্তা।
মোস্তফা গ্রুপ
চট্টগ্রামসহ সারাদেশের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় একচেটিয়া ব্যবসা করতো মোস্তফা গ্রুপসহ হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই মোস্তফা গ্রুপের অবস্থা এখন নাজুক। যুগের পর যুগ ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় শীর্ষ অবস্থানে থাকা গ্রুপটি গত কয়েক বছর ধরে ভোগ্য পণ্য ব্যবসায় নেই। শিপ ব্রেকিং এসোসিয়েশনের দীর্ঘদিনের সভাপতি হেফাজতুর রহমানের মোস্তফা গ্রুপের ব্যবসা নেই শিপ ব্রেকিংয়েও। ভোজ্য তেলের ব্যবসা বন্ধ করে বিক্রি করে দিয়েছে ট্যাংক টার্মিনাল। বন্ধ হয়ে গেছে গ্রুপটির ভোগ্যপণ্য, ভোজ্যতেল, শিপ ব্রেকিং, কৃষি (চা বাগান, রাবার বাগান, আম বাগান), কাগজ, মৎস (চিংড়ি), স্টিল, পরিবহণ, শিপিং, সিকিউরিটিজ ও পোষাক খাতের বহু প্রতিষ্ঠান। যে কয়টি প্রতিষ্ঠান টিকে আছে সেসব প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও ভালো নয়। প্রায় ৭০ বছর ধরে ব্যবসা করে আসা মোস্তফা গ্রুপের কাছে বর্তমানে ব্যাংকসহ ৩০টিরও বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
ঋণের টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রুপটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা দায়ের করেছে। এর মধ্যে ৩৭ টি মামলায় প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
গ্রুপটির প্রবক্তা মোস্তাফিজুর রহমানের বর্তমান প্রজন্মের অনৈক্য গ্রুপটির নাজুক অবস্থাকে আরো ত্বরান্বিত করেছে। সংশ্লিষ্টদের অনেকে বলেছেন, গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা মোস্তাফিজুর রহমানের সাত ছেলে গ্রুপটির বিভিন্ন খাতের ব্যবসা পরিচালনা করত। ২০১০-১২ সালের পর থেকে গ্রুপটির অবস্থা যখন আস্তে আস্তে খারাপ হতে থাকে তখন কর্ণধাররা গ্রুপটির ব্যবসা পরিচালনা থেকে মনোযোগ কমিয়ে ফেলে। ওই সময় থেকে কর্ণধাররা নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে এরপর থেকে কর্ণধারদের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমান বাড়লেও গ্রুপের অবস্থা খারাপ হতে থাকে।
জানা গেছে, ১৯৫২ সালে ভোগ্যপণ্য ব্যবসার মাধ্যমে ব্যবসা শুরু হয় চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার মোস্তাফিজুর রহমানের। এরপর বিভিন্ন খাতে ব্যবসার পরিধি বাড়িয়ে গড়ে তোলে মোস্তফা গ্রুপ। যা এক সময় দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি শিল্পগ্রুপ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ২০০৬ সালে এই শিল্প উদ্যোক্তার মৃত্যুর পর গ্রুপটির পরিচালনার দায়িত্বে আসেন তার সন্তানরা। সাত ছেলে গ্রুপটির মালিকানায় থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে মোস্তফা গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমানের বড় ছেলে হেফাজতুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন জহির উদ্দিন। তাদের ভাই কফিল উদ্দিন গ্রুপটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, শফিক উদ্দিন ভাইস চেয়ারম্যান ও কামাল উদ্দিনসহ তিনজন পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। এদের মধ্যে হেফাজতুর রহমান দীর্ঘদিন শিপ ব্রেকার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ও ওয়ান ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। এছাড়া জহির উদ্দিন ব্যাংক এশিয়া ও ওয়ান ব্যাংকের পরিচালক এবং শফিক উদ্দিন ব্যাংক এশিয়ার পরিচালক ছিলেন। তবে বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে মোস্তফা গ্রুপ।
নূরজাহান গ্রুপ
এক সময়ের ভোগ্যপণ্য ব্যবসার অন্যতম জায়ান্ট চট্টগ্রামভিত্তিক নূরজাহান গ্রুপ। ভোজ্যতেল, গম, মসলাসহ ভোগ্যপণ্যে আধিপত্যের সঙ্গে ব্যবসা করলেও আগের সেই অবস্থা আর নেই। গত কয়েক বছর ধরে গ্রুপটির ব্যবসা সংকুচিত হলেও বাড়ছে দেনার পরিমাণ। এরমধ্যে গ্রুপটির কাছে পাঁচ ব্যাংকের দেনার পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
চট্টগ্রামে খেলাপির দিক থেকে ভোগ্যপণ্যের পরে রয়েছে ইস্পাত-শিপব্রেকিং খাত। গত আট বছরে এই খাতে মোট খেলাপির পরিমান ৯ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা। ১ হাজার ৫৯১কোটি টাকা নিয়ে খেলাপির তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে এগ্রো বেইসড ইকোনোমি। খেলাপির তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে তৈরি পোষাক খাত। এই খাতে খেলাপি পরিমান ১ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। ৯০১ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে ৫ম অবস্থানে রয়েছে আবাসন খাত। ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে ৪ হাজার ৭৫৭ টি অর্থঋণ মামলা দায়ের হয়েছে। মামলা দায়েরের তুলনায় মামলা নিষ্পত্তির হার খুবই কম। অর্থঋণ আদালতে বর্তমানে একজন যুগ্ম জেলা জজ দায়িত্ব পালন করছেন।
বিভিন্ন ব্যাংকের অর্থঋণ মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ২০১৩ সাল থেকে অর্থঋণ আদালতে সর্বোচ্চ অর্থাৎ গড়ে প্রতিবছর ৬শ মামলা দায়ের হচ্ছে। কিন্তু মামলা নিষ্পত্তির হার ১০ শতাংশেরও কম। বাণিজ্য নগরী হিসেবে চট্টগ্রামে ব্যাংকিং বিনিয়োগ বেশি। আবার খেলাপির পরিমানও বেশি। ব্যাংকে রাখা সাধারণ মানুষের আমানত ফিরিয়ে দিতে অর্থাৎ ব্যাংকের দায়ের করা মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে অর্থ আদায় করতে চট্টগ্রামে অন্তত দুটি অর্থ ঋণ আদালতের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
ভোগ্যপণ্য খাতে বিভিন্ন ব্যাংকের বিনিয়োগ করা অর্থের মধ্যে সর্বশেষ গত এক বছরেই (২০২০সাল) প্রায় ৬০০ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে। চট্টগ্রামের ভোগ্যপণ্য খাতের ১৫ টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই খেলাপি ঋণ আদায়ে এরই মধ্যে আদালতে দারস্থ হয়েছে পাওনাদার ব্যাংক। এর আগের সাত বছর অর্থাৎ ২০১৩-১৯ সালে পর্যন্ত এই খাতের ২৮ টি বড় শিল্পগ্রুপসহ দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠানের কাছে খেলাপির পরিমান প্রায় ১৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সেই হিসেবে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভোগ্যপণ্য খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট খেলাপির পরিমান ১৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের তালিকায় আগের প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে এবার যোগ হয়েছে মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্সের কাছে এবি ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার ১০৮ কোটি টাকা, মেসার্স জয়নাব ট্রেডিংয়ের কাছে অগ্রণী ব্যাংক আসাদগঞ্জ শাখার ১৯১ কোটি টাকা, মেসার্স এম এন আক্তার এন্টারপ্রাইজের কাছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক চাক্তাই শাখার ৫৭ কোটি টাকা, ছগীর এন্ড ব্রাদার্সের কাছে পদ্মা ব্যাংকের ২৮ কোটি টাকা, গাজী ট্রেডিংয়ের কাছে ট্রাস্ট ব্যাংকের ১৫ কোটি টাকা, বেঙ্গল ট্রেডিংয়ের কাছে পদ্মা ব্যাংকের সাড়ে ১৫ কোটি টাকা, আরমান ট্রেডার্সের কাছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সাড়ে ৩৯ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ট্রেডার্সের কাছে পদ্মা ব্যাংকের ৩৪ কোটি টাকা, আবরার ট্রেডিংয়ের কাছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১১ কোটি টাকা ও এ কে এন্টারপ্রাইজের কাছে ঢাকা ব্যাংকের ১০ কোটি টাকা ঋণ আদায়ে মামলা করেছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।
এই পর্যন্ত ভোগ্যপণ্য খাতে খেলাপি হওয়া বড় শিল্প গ্রুপের মধ্যে এস এ গ্রুপের কাছে ১৮ ব্যাংকের ৪০০০ কোটি টাকা, এমইবি'র কাছে ১৫ ব্যাংকের ১০০০ কোটি টাকা, মোস্তাফা গ্রুপের কাছে ৩০ ব্যাংকের ২০০০ টাকা, মেসার্স সিদ্দিক ট্রেডার্সের কাছে ১৫ ব্যাংকের ১০০০ কোটি টাকা, ইমাম গ্রুপের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের ৮০০ টাকা, নূরজাহান গ্রুপের কাছে ২০০০ কোটি টাকা, বাদশা গ্রুপের কাছে ৫০০ কোটি টাকা, ইয়াছির এন্টারপ্রাইজের কাছে ৯০০ কোটি টাক, গাছ কামালের কাছে ৬০০ কোটি টাকা, আহাদ ট্রেডিংয়ের কাছে ২ ব্যাংকের ২১০ টাকা, আলম এন্ড কোংয়ের কাছে ৩০০ টাকা, বলাকা গ্রুপের কাছে ৮০০ কোটি টাকা, জাহিদ এন্টারপ্রাইজের কাছে ২০০ কোটি টাকা, জয়নাব ট্রেডিংয়ের কাছে ২০০ কোটি টাকা, জেসি ফুডের কাছে ৩ ব্যাংকের ১০০ কোটি টাকা, ইয়াকুব গ্রুপের কাছে ৫০ কোটি টাকা, মনোয়ারা ট্রেডিংয়ের কাছে ২৩০ কোটি টাকা, ন্যাম করপোরেশনের কাছে ২৫০ কোটি টাকা, মহিউদ্দিন করপোরেশনের কাছে ৬২ কোটি টাকা পাওনা আটকে রয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর।
নূরজাহান গ্রুপের কর্ণধার জহির উদ্দিন রতন বলেন, ২০১২-২০১৩ সালে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যের দামের উত্থান-পতনে বড় লোকসান হয়েছে। শত শত কোটি লোকসান দেয়ার পরও ব্যাংকের টাকা শোধ করেছি। কিন্তু শতভাগ ঋণ শোধ করতে না পারায় বছর বছর ঋণের টাকার পরিমান বাড়ছে। অন্যদিকে খেলাপিতে পরিণত হওয়ায় ব্যাংকগুলো রি-ফাইন্যান্স করছে না। এতে ব্যবসায় ফিরে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এই ব্যবসায়ী আরো বলেন, কিছু প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে ভোগ্যপণ্য খাতে যত বড় বড় শিল্পগ্রুপ খেলাপি হয়েছেন তারা প্রত্যেকেই পণ্য আমদানি করে বড় লোকসান দিয়ে দেউলিয়া হয়েছে। ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে পুরোনো ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় ফিরিয়ে এনে রি-ফাইন্যান্স করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী।
চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, শেয়ার বাজারের পর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভোগ্যপণ্য ব্যবসা। কারণ এতে কোন কোন সময় চাহিদার অপ্রতুল পণ্য বাজারে সরবরাহ হলে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার সম্ভবনা থাকে। একইভাবে চাহিদার কয়েকগুন বেশি পণ্য আমদানি হয়ে আমদানিকৃত খরচের অর্ধেক দামে পণ্য বিক্রি করে দেউলিয়া হওয়ার উদাহরণও রয়েছে। তাই এই খাতে ব্যবসা এবং বিনিয়োগে ব্যবসায়ী এবং ব্যাংক উভয়পক্ষের সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে।
ভোগ্যপণ্য খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা খুবই সহজ। অল্প পরিমান বিনিয়োগ নিয়ে বাজারে ব্যবসা শুরু করেন নতুন নতুন উদ্যোক্তা। এরপর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাচাই-বাছাই না করে বিনিয়োগ করে প্রতিষ্ঠানগুলোতে। ঋণ গ্রহীতারা ঋণের টাকায় ব্যবসার পাশাপাশি জমি ক্রয়, বাড়ি নির্মাণসহ বিভিন্ন ভোগ বিলাসে খরচ করে। এরপর ব্যবসার দরপতনে আটকে যায় ব্যাংক ঋণ। এভাবে দেশের ঐতিহ্যবাহী ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে বছর বছর খেলাপি ঋণের সংখ্যা বাড়ছে।
আদালতের তথ্যমতে, গত আট বছরে (২০১৩-২০২০) চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে। এরমধ্যে গত বছর ২০২০ সালে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে প্রায় ২ হাজার ৪২১ কোটি টাকা আদায়ে মামলা করেছে পাওনাদার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এর আগে ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে ৬ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা, ২০১৬ সালে ৭ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৯৫২ কোটি, ২০১৪ সালে ২ হাজার ১১২ কোটি এবং ২০১৩ সালে ৫ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা পাওনা আদায়ে মামলা করেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।