কোভিড থেকে সেরে উঠছে অর্থনীতি
দেশে বর্তমানে স্বাস্থ্যগত দিক থেকে দেখলে মনে হচ্ছে, কোভিড -১৯ এখন আর সরকারের অগ্রাধিকারে থাকবে না।
কারণ প্রতিদিন করোনা শনাক্তের পরীক্ষার সংখ্যা কেবল কমছে। আগে যেখানে প্রতিদিন ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার নমুনা পরীক্ষা হতো, এখন তা ১০-১৫ হাজারে নেমে এসেছে। ভারত বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করলে, বাংলাদেশে প্রতিদিন অন্তত ১ লাখ নমুনা পরীক্ষা হওয়া উচিত।
এদিকে একদিনে সর্বোচ্চ ৯০ হাজার করোনা শনাক্তের রেকর্ড করেছে প্রতিবেশী ভারত। আর এমন সময়েই বাংলাদেশে নানাভাবে করোনা বিষয়ে যেন উদাসীন হয়ে পড়ছে। বেশিরভাগ মানুষই এখন আর এদেশের নমুনা পরীক্ষায় আস্থা রাখতে পারছেন না।
অন্যদিকে করোনা পরীক্ষা করাতে বাধ্যতামূলক যে ফি দেওয়ার নিয়ম করেছে সরকার, এতেও পরীক্ষা করাতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে সাধারণ মানুষ। আর হাসপাতালগুলোর সেবার মান নিয়ে আস্থা হারিয়ে বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন আক্রান্তরা।
এমনকি অবস্থা গুরুতর হয়ে গেলেও হাসপাতালে না গিয়ে বাড়িতেই অক্সিজেন সিলিন্ডার এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন তারা।
এদিকে সাদা চোখে আমরা দেখতে পাচ্ছি- অর্থনীতি সচল হয়ে উঠছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে করোনার সংক্রমণ কিন্তু ঠিকই ছড়িয়ে পড়ছে। ভারতে, বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় সংক্রমণের হার প্রতিনিয়তই বাড়ছে। সুতরাং কেবল আমাদের এখানেই সংক্রমণের হার দিন দিন কমে যাচ্ছে- এটা ভেবে নেওয়ার কোন কারণ নেই। আমরা আসলে জানিই না দেশে করোনার মূল পরিস্থিতিটা কি, কিংবা আমরা হয়তো জানতেই চাই না।
সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালিক বলেছেন, 'বাংলাদেশ থেকে করোনা চলে যাচ্ছে। আমরা খুব শীঘ্রই করোনামুক্ত হব'- এই বক্তব্যের পর মনে হচ্ছে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারেরও খুব একটা মাথাব্যথা নেই।
তাই খুব ক্ষীণ হলেও, আসন্ন করোনা ভ্যাকসিনই একমাত্র ভরসার জায়গা আমাদের। আর তাই দেশের সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষকে যেন এই করোনা-প্রতিষেধকের আওতায় আনা যায়, সরকারকে সে ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে।
সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন যারা, করোনা প্রতিষেধকের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। তাদেরকে টিকা নিতে উতসাহিত করতে, করোনা প্রতিষেধক নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানাতে উদ্যোগ নিতে হবে। মোট জনগণের ৬০-৭০ শতাংশ মানুষকে যদি এই প্রতিষেধকের আওতায় আনা না যায়, তবে এই মারাত্মক কোভিড-১৯ ভাইরাস দমনে সব ধরণের কর্মকাণ্ডই ব্যর্থ হবে।
তার মানে বাংলাদেশ থেকে কোভিড-১৯ দূর করতে অন্তত ১০ থেকে ১২ কোটি মানুষকে করোনার টিকা দিতে হবে। যেহেতু করোনা টিকার অন্তত ২টি ডোজ নিতে হয়, তার মানে প্রায় ২০ থেকে ২৫কোটি ডোজ প্রয়োজন হবে।
এখন এই টিকাগুলো নিরাপদে দেশে আনা এবং সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা একটি চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। এজন্য বাংলাদেশ সরকারকে সব রকমের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে, ভ্যাকসিনগুলো আসা, তাদের পরিবহন থেকে শুরু করে, সংরক্ষণ ও বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছানো পর্যন্ত একটি দক্ষ পরিচালনা ব্যবস্থা তৈরি রাখতে হবে। যখন যে দেশ থেকেই একসঙ্গে অনেক ভ্যাকসিন আসুক না কেন, যাতে করে সুষ্ঠুভাবে সেগুলো সাধারণ মানুষের জন্য প্রস্তুত রাখা যায়।
এমনিতেই বাংলাদেশে করোনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হবে কি হবে না- বেশ সময় নিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অথচ ইতোমধ্যেই অন্য অনেক দেশে ভ্যাকসিনের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। এখন অন্তত ভ্যাকসিন আসার পর তা বন্টনে যেন কোন প্রকার গোলযোগ সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে সরকারের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
এদিকে স্বাস্থ্যখাতে না হলেও অর্থনীতি খাত কিছুটা হলেও সেরে উঠেছে করোনা থেকে। রফতানি বিশেষ করে, তৈরি পোশাক খাতে রফতানি খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান দেশগুলোর অনেক অর্ডার বাতিল বা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন পুরোনো সেসব অর্ডার নিয়েই কাজ শুরু হয়েছে গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে।
বিজিএমইএ এর তরফ থেকে বলা হয়েছে, করোনার কারণে প্রায় ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল ও পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কারখানাগুলোতে পুরানো এই অর্ডারগুলোরই কাজ শুরু হয়েছে। সেপ্টেম্বর জুড়েই এই কাজ চলবে।
এর মধ্যে কিছু নতুন অর্ডারও আসছে, কিন্তু সেগুলো কতটা টেকসই হবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপেও এরমধ্যেই করোনার দ্বিতীয় প্রবাহ শুরু হবার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এই বছরের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে করোনা ভ্যাকসিন পৌঁছে যাবার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এই দেশুগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা করোনা-পূর্বের অবস্থায় ফিরতে ২০২১ সাল শেষ হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন অর্থনৈতিক অবস্থা চালু হলেও পণ্য বিক্রির পরিমাণ বাড়েনি। আগের মতো দিনে ৫০-১০০ জন ক্রেতার দেখা না পেলেও অন্তত কিছু ক্রেতা কেনাকাটা করতে আসছে, তাতেই খুশি বিক্রেতারা।
একজন রিকশাওয়ালার আয় দিনে দাঁড়িয়েছে ৪০০-৫০০ টাকায়, করোনা পূর্বে যার আয় ছিল এর দ্বিগুণেরও বেশি। তবু একেবারেই কোন আয় না থাকার চেয়ে তা অনেক ভালো বলেই মনে করছেন রিকশাওয়ালারা। পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরতে ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লেগে যাবে।
তবু পশ্চিমা উন্নত দেশগুলর তুলনায় আমাদের সেরে উঠতে হবে অনেক দ্রুত। কেননা, এদেশের নিম্ন আয়ের মানুষদের বেঁচে থাকার জন্যই কোভিডের ভয় ভুলে কাজে নেমে পড়তে হবে যত শীঘ্র সম্ভব।
তবে বেশ কিছু ক্ষেত্র এখনও কাজ শুরু করতে পারেনি। যেমন- পর্যটন খাত, রেস্টুরেন্ট ও হোটেল, রিয়েল এস্টেট, পরিবহন ও যোগাযোগ, এয়ারলাইন্স- এই খাতগুলো এখনও ব্যবসা চালু করতে বেগ পেতে হচ্ছে। পণ্য পরিবহন ও সরকার প্রণীত প্রণোদনা মান উন্নত হলেও, ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ব্যবসাগুলো পিছিয়ে পড়ছে বাজারে। কারনে এদের অনেকেই এখনও প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় আসতে পারেনি।
বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও রফতানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে। কিন্তু দেশের সমস্ত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য পুরো ১ বছরের জন্য ক্ষতিপূরনের ব্যবস্থা করা বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়াবে সরকারের জন্য।
মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই আগামী ১ বছরের মধ্যে ঋণ শোধ করতে পারবে না। এই ঋণ শোধের জন্য এইসমস্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য সময় বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
এই সমস্ত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অনেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত ঋণ শোধ করা ও আপদকালীন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিতে টাকা জমানোর প্রতি বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। যতদিন না পর্যন্ত সাধারণ ক্রেতারা বাজারে পণ্য কিনতে টাকা খরচ করবেন, ততদিন বাজারে পণ্য জমে থাকবে, টাকা আসবে না, অর্থাৎ অর্থনীতি সচল হবে না। আর বিনিয়োগের অবস্থা তো আরও খারাপ। আগের অবস্থায় ফিরতে আরও বেশ খানিকটা সময় লাগবে।
এই পরিস্থিতেতে সরকারের উচিত সাময়িক সামাজিক নিরাপত্তা প্রোগ্রামের আওতায় শহরের নিম্ন আয়ের ও দরিদ্র মানুষগুলো, কর্মহীন শ্রমিক ও তাদের পরিবারের জন্য নগদ অর্থ সরবরাহের ব্যবস্থা করা। এতে করে গৃহস্থালীতে পণ্যের চাহিদা অনুযায়ী বাজারে পণ্য বিক্রি বাড়বে, অর্থাৎ অর্থনীতি সচল হবে।
- লেখক আহসান এইচ মনসুর পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান