কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আরও বাড়ল
আয়ের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার জন্য আরও এক বছর সুযোগ পেলেন অপ্রদর্শিত অর্থের মালিকরা। পুঁজিবাজার, আবাসন, ব্যাংক সঞ্চয় ও নগদে টাকা জমার প্রায় সবগুলো খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে এ সুযোগ পাবেন তারা।
নতুন কারখানায় বিনিয়োগ করলে এখন মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যাবে।
এই সুযোগ রেখে গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল ২০২১-২২ অর্থবছরের অর্থবিল উত্থাপন করেন। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে পরে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।
আগামী অর্থবছরে একটি বিশেষ প্যাকেজের আওতায় মাত্র ১০ শতাংশ করের বিনিময়ে উৎপাদন শিল্পে নতুন কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে সরকার।
এছাড়া শেয়ারবাজারে ২৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা বিনিয়োগ করা যাবে। তবে ওই ২৫ শতাংশ করের ওপর ৫ শতাংশ জরিমানা দিতে হবে। অর্থ আইন অনুযায়ী, ওই একই শর্তে নগদ টাকা, ব্যাংক ডিপোজিট ও সঞ্চয়পত্রও বৈধ করার সুযোগ থাকছে।
অ্যাপার্টমেন্ট ও জমিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা বৈধ করার জন্য প্রতি বর্গমিটারে ২০০ থেকে ৬ হাজার টাকা দিতে হবে।
আয়কর রিটার্নে এ ধরনের অপ্রদর্শিত অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে অর্থ আইন সংশোধন করে একটি দায়মুক্তি বিধান করেছে সরকার।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ১০ হাজার ৩৪ জন ব্যক্তি ১৪,২৯৫ কোটি টাকা সমমূল্যের নগদ অর্থ ও সম্পদ বৈধ করে নিয়েছেন। এ থেকে এনবিআর কর পেয়েছে ১,৪৩৯ কোটি টাকা।
এদের মধ্যে ৯৬৯২ জন নগদ, ফিক্সড ডিপোজিট রিসিপ্ট, সঞ্চয়পত্র ও সম্পদের মাধ্যমে ১৩,৮৬০ কোটি টাকা সাদা করেছেন। এর বিপরীতে কর দিয়েছেন ১,৩৯০ কোটি টাকা। ৩৪১ জন ব্যক্তি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে ৪৩৫ কোটি টাকা বৈধ করেন। এবং এর বিপরীতে তারা ৪৯ কোটি টাকা কর দিয়েছেন।
দেশে কালো টাকার পরিমাণ সম্পর্কে সঠিক বর্তমানে কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১০ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশে মোট কালো টাকার পরিমাণ বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ৩৭ শতাংশ হবে।
টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে পাস করা অর্থবিল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিডিপি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগ দেশের দুর্নীতি দমনের পথে একটি বড় বাধা।
তিনি বলেন, অপ্রদর্শিত টাকা সাদা করার এই সুযোগটি কর আদায়ের নীতিকাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক। তিনি আরও, কালো টাকা সাদা করতে দেওয়া কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত নয়, এবং এটি বৈষম্যমূলক ও অনৈতিক সিদ্ধান্ত।
অর্থ আইনের অধীনে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর (এমএফএস) ওপর প্রস্তাবিত বাড়তি কর্পোরেট করও কমিয়েছে সরকার। প্রস্তাবিত বাজেটে এমএফএস-এর ওপর ৪০ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এ করের পরিমাণ কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে।
এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী এমএফএসের ওপর বিদ্যমান কর ৩২.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে এমএফএসগুলোকে ব্যাংক, বিমা কোম্পানি ও অন্যান্য আর্থিক সংস্থার সমান ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হতো।
পরে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত না করে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের দাবির প্রেক্ষিতেই রাজস্ব বোর্ডের দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী অর্থবিল ২০২১-এ পরিবর্তন এনেছে সংসদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ মাস পর্যন্ত সক্রিয় এমএফএস অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ৩.৪৬ কোটি। দেশে এখন ১৫টি এমএফএস আছে, যাদের ব্যাংকিং পরিষেবাও রয়েছে। বর্তমানে এমএফএস সেবাদাতাদের শেষে প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়।
রেস্তোঁরা পরিষেবার ভ্যাটও কমিয়েছে সরকার। এখন থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোঁরাগুলোর ওপর ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য হবে। আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই যেসব রেস্তোরাঁয়, ওগুলোর ভ্যাটের হার ৭.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করে হয়েছে।
এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে সব ধরনের রেস্তোঁরার ওপর ভ্যাট হার কমানোর দাবি করেছিলেন রেস্তোঁরা মালিকরা।
বাংলাদেশ রেস্তোঁরা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমরান হাসান বলেছেন, তারা চেয়েছিলেন রেস্তোরাঁগুলোর ওপর যেন শ্রেণি অনুযায়ী ভ্যাট ধরা হয়। তারা চেয়েছিলেন, নিম্ন ও মধ্যম সারির রেস্তোরাঁর ওপর ৩-৫ শতাংশ, সুসজ্জিত রেস্তোরাঁর ওপর ৭.৫ শতাংশ, এবং ফাইভ-স্টার ও ফোর-স্টার শ্রেণির রেস্তোরাঁর ওপর যেন ১০ শতাংশ ভ্যাট ধরা হয়।
৫০ হাজার টাকার বেশি ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য ব্যাংক ও এমএফএসের মতো আনুষ্ঠানিক চ্যানেল ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল প্রস্তাবিত বাজেটে। এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার। এখন কোনো প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল কিনলে তার দাম ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত নগদে পরিশোধ করতে পারবে।
এদিকে, ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন নগদে দেওয়া যাবে। প্রস্তাবিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার টাকা।
- প্রতিবেদনটি ইংরেজিতে পড়ুন: Money whitening scope widened