কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত হবে ‘আত্মঘাতী’, ক্ষতির আশঙ্কা জানালেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা
১৪ দিনের কঠোর লকডাউনে কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য 'আত্মঘাতী' হবে বলে মন্তব্য করেছেন পোশাক প্রস্তুতকারীরা। পোশাক খাতের রপ্তানি আয়ের পুনরুদ্ধার যখন মহামারি-পূর্ব পর্যায়ে পৌঁছাতে চলেছে, তখন কারখানা বন্ধের এই সিদ্ধান্তে পুনরায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করেছেন তারা।
এছাড়া, লকডাউন শিথিল করায় লাখ লাখ মানুষ গ্রামে যাওয়ার ফলে করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন গার্মেন্ট মালিকরা।
ঈদ-ঊল-আজহা উপলক্ষে এক সপ্তাহের শিথিলতার পর ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত পুনরায় কঠোর লকডাউনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সময় দেশের সব ধরনের কারখানা বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ঈদকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই ভোর ৬.০০টা পর্যন্ত লকডাউন শিথিল করার ঘোষণা দেয়।
ঈদের ছুটিসহ কঠোর লকডাউনে কারখানাগুলো টানা ১৮ দিন বন্ধ থাকবে। দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় সময়মতো চালান পাঠানো কঠিন হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন পোশাক রপ্তানিকারকরা।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, "জুন, জুলাই এবং আগস্ট মাস তৈরি পোশাক রপ্তানির ব্যস্ত মৌসুম। এ সময় মূলত শীতের পোশাক রপ্তানি করা হয়ে থাকে।"
"বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা এই সময়কালে তৈরি পোশাকের ৪০ শতাংশ রপ্তানি করে থাকেন। গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের ক্রেতারা ক্রয়াদেশ বাতিল করতে পারেন। যার ফলে, আরএমজি খাতে বিশাল লোকসান হবে," বলেন তিনি।
এমনকি, ক্রেতারা বসন্ত এবং গ্রীষ্মকালীন মৌসুমের রপ্তানি আদেশ প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোতে পাঠাতে পারেন বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি বেশ কিছুদিন ধরেই সরকারকে কঠোর লকডাউন আরোপের পরামর্শ দিয়ে আসছে। কঠোর লকডাউন দেওয়া না হলে বাড়তে থাকা কোভিড সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে, ঈদ-ঊল-আজহার সময় কারখানাগুলোতে সাধারণত ঈদের ছুটি থাকায় ঈদের পর লকডাউন কঠোর করার সময়সূচি নির্ধারণ করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এখন পর্যন্ত, কঠোর লকডাউনে তৈরি পোশাকসহ সকল কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত অব্যাহত আছে।
শীতকালীন মৌসুমের চালান বাড়তে থাকায় এপ্রিলের পর দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি দ্রুত পুনরুদ্ধার লাভ করেছে।
আগের বছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে আরএমজি রপ্তানি ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩১.৪৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছে। তবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে, আরএমজি খাতে আয়ের পরিমাণ ছিল ৩৪.১৩ বিলিয়ন ডলার।
বিজিএমইএ সহ-সভাপতি আরও বলেন, "আমরা ১৯ জুলাই থেকে ঈদের ছুটি দিব। অন্যদিকে, ৬ জুলাই হলো শুক্রবার। সব মিলিয়ে, কারখানা ১৮ থেকে ১৯ দিনের জন্য বন্ধ থাকবে। সময়টা অনেক বেশি।"
"৩০ জুলাই পর্যন্ত শাটডাউন থাকলে যথাযথ হতো," বলেন তিনি।
লকডাউন শিথিল করার বিষয়ে তিনি বলেন, "সরকার কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে এই ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা হিতে বিপরীত হতে পারে। কারখানা কর্মীরা এই ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়ে পুনরায় ঢাকা ফিরে আসলে সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে।"
"কর্তৃপক্ষের উচিত ঈদের ছুটির সাথে এই এক সপ্তাহে মানুষের চলাচলে আরও কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা। ঈদের পর কঠোর লকডাউনে যাওয়ার থেকে এই পদক্ষেপ আরও অধিক কার্যকর হতো," বলেন তিনি।
বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব নিট পোশাক কারখানা প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে আলাপকালে বলেন, "পোশাক শিল্প কারখানাগুলো যখন পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে, তখন হুট করে দুই সপ্তাহের জন্য সরকারের লকডাউন ঘোষণা পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত করবে।"
"সাপ্তাহিক ও ঈদের ছুটিসহ প্রকৃতপক্ষে তিন সপ্তাহের অব্যাহতি পাবেন পোশাক শ্রমিকরা। ফলে, মহামারির মধ্যেও এই সময়ে তারা গ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে উৎসাহিত হবেন। এরকম হলে গ্রামাঞ্চলে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা না থাকায় কোভিড পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে," বলেন তিনি।
এছাড়া, মহামারি চলাকালে শিল্পাঞ্চলে কোভিডের প্রাদুর্ভাব ছড়ানোর কোনো রেকর্ড নেই বলেও দাবি করেন ফজলুল হক।
"পোশাক প্রস্তুতকারীরা এখন আগামী বসন্ত ও গ্রীষ্মকালীন মৌসুমের জন্য নতুন ক্রয়াদেশ নিশ্চিত করতে ব্যস্ত। আসন্ন মৌসুমে আরও ভালো করার এটাই সবচেয়ে বড় সুযোগ। কিন্তু, দীর্ঘ শাটডাউনের ফলে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে," বলেন তিনি।
কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে বিদেশি ক্রেতারা বিকল্প খুঁজবেন বলেও আশঙ্কা করেন তিনি। চীন, ভিয়েতনাম এবং ভারতের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোতে উৎপাদন খরচ বেশি হলেও সেখানকার কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকায় ক্রেতারা সেদিকে ঝুঁকবেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক আরও বলেন, আরএমজি কর্মীরা এই মুহূর্তে পরবর্তী শীতের চালান নিয়ে ব্যস্ত।
"আমরা যদি সমুদ্র পথে চালান পাঠাতে ব্যর্থ হই, তাহলে আকাশপথে পরিবহন খরচ বাড়বে," বলেন তিনি।
টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিজিএমইএ পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, "আমরা জুলাই থেকে আগস্টের মধ্যে শীতের চালান পাঠানোর চাপে আছি। লকডাউন দেওয়ায় আমরা কী করব তা জানি না। তবে, আমাদের সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে।"
"চলমান লকডাউন এবং পরিবহন সংকটের কারণে পোশাক রপ্তানিকারকরা কাঁচামালের অর্ডার দেওয়ার এক মাস পর তা পাচ্ছেন। একই কারণে, মে মাসে যে চালান পাঠানোর কথা ছিল, তার সময়সীমা জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে আমরা বিদেশি ক্রেতাদের অনুরোধ জানিয়েছিলাম।"
"এখন মে মাসের পণ্য আগস্টে পাঠানো হলে কী হবে তা আমরা জানি না," বলেন তিনি।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, "শুরুতে আমরা ঈদের জন্য ১৮ থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু সরকার, ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর লকডাউন আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।"
"ভারত এবং ভিয়েতনামের মতো দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশে কারখানা খোলা রয়েছে। আমরা যদি এত দীর্ঘ সময় কারখানা বন্ধ রাখি, তাহলে সরবরাহ এবং চালান পাঠানোর ক্ষেত্রে তা আত্মঘাতী হবে," বলেন শোভন।
"প্রতিটি উৎপাদন এবং চালানের পরিকল্পনা পর-পর হওয়ায় উদ্ভূত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে ছয় মাস সময় লাগবে। একটির ফলে আরেকটি ঝামেলার সূত্রপাত বাড়তে থাকার পাশাপাশি সুনাম ক্ষুণ্ণ হওয়ার পরিণতি হবে ভয়াবহ," বলেন তিনি।
তবে, ২০ থেলে ২৯ জুলাই পর্যন্ত লকডাউন আরোপ করে এই মাসের শেষে কারখানা খুলে দেওয়ার বিকল্প সিদ্ধান্তের প্রস্তাব দেন তিনি।
"কর্মীরা লকডাউনে ঈদের ছুটি উদযাপন করতে পারবেন, পাশাপাশি এর ফলে আমাদের উৎপাদন ও চালানে সৃষ্ট বিলম্বও কমানো সম্ভব হবে," বলেন তিনি।
বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএইএ) সভাপতি এম শাহাদাৎ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "একজন কারখানা মালিককে যদি প্রতি মাসে দুই কোটি টাকার ব্যাংক সুদ গুনতে হয়, তাহলে ১৫ দিন কারখানা বন্ধ থাকলে সে সুদের এক কোটি টাকাই তুলতে পারবে না।"
"পশ্চিমা কিছু দেশ ইতোমধ্যে সবকিছু পুনরায় চালু করেছে। অন্যরাও তাদের অনুসরণ করতে যাচ্ছে। এখন আমরা যদি রপ্তানি বাজারে সময়মতো পণ্য পাঠাতে ব্যর্থ হই, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তারা বিকল্প উৎস খুঁজে নিবে। আমার মতে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত হঠকারী," বলেন তিনি।
সরকারের সাথে এই বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা চলছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
গত বছর ২৫ মার্চ সরকার সকল অফিস এবং কারখানা বন্ধ করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে।
২০২০ সালের ২৩ এপ্রিল সরকার কোভিডের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পুনরুদ্ধারে ছুটির মাঝেই কয়েকটি সরকারি দপ্তর পুনরায় খুলে দেয়। ২৬ এপ্রিল, স্বাস্থ্যবিধি মেনে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা খোলার অনুমতি দেওয়া হয়।
বিজিএমইএ'র তথ্যানুসারে, এখন পর্যন্ত দুই হাজার ৩৫২ জন পোশাক শ্রমিক কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে আট জন মারা গেছেন। তৈরি পোশাক খাতে প্রায় ৪০ লাখ কর্মী কাজ করেন।