কর ফাইলে গাড়ির তথ্য লুকানো করদাতাদের খোঁজে এনবিআর
ব্যক্তিগত বা পরিবহনের জন্য গাড়ি কিনেছেন কিন্তু আয়কর ফাইলে ওই তথ্য দেখাননি, কিংবা দেখালেও কম মূল্য দেখিয়েছেন, এমন করদাতাদের খোঁজ শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর বিভাগ।
ইতিমধ্যে আয়কর বিভাগ এ-সংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য উদ্ধার করেছে।
এনবিআরের আয়কর বিভাগ সূত্র জানায়, রাজধানী ও এর বাইরের বেশ কয়েকটি আয়কর সার্কেল অনুসন্ধান শেষ করেছে। এর মধ্যে রাজধানীর একটি সার্কেলের অনুসন্ধান শেষে দেখা গেছে, ৫ হাজার করদতার মধ্যে ২০০ জন গাড়িতে বিনিয়োগ থাকলেও তারা আয়কর ফাইলে ওই বিনিয়োগ বা এ-সংক্রান্ত তথ্য দেখাননি। এতে কর ফাঁকি পাওয়া গেছে ২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
দেশে ৩১টি কর জোনের অধীনে কর সার্কেল অফিস রয়েছে ৬ শতাশিক।
আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান শেষ হবে বলে আশা করছেন অনুসন্ধানের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা। এ প্রক্রিয়ায় কর ফাইলে না দেখানো প্রায় ৩০ হাজার গাড়ির তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন তারা, যাতে অন্তত ৭০০ কোটি টাকার কর ফাঁকি উদ্ঘাটনের সম্ভাবনা দেখছেন।
বাংংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছ থেকে গাড়ির তথ্য নেওয়ার পর ওই তথ্যের সঙ্গে করদাতাদের কর ফাইলের তথ্য মিলিয়ে এ অনুসন্ধান কাজ চালানো হচ্ছে। গাড়ি নিবন্ধনের সময় ক্রয়মূল্য বাধ্যতামূলকভাবে বিআরটিএকে জানাতে হয়।
গত বছর থেকে বিআরটিএ ও এনবিআরের মধ্যে ইন্টিগ্রেশন হওয়ার পর তারা একে অন্যের তথ্যভাণ্ডার ব্যবহার করতে পারছে। ফলে বিআরটিএর তথ্যভাণ্ডারে দেওয়া গাড়ির ক্রয়মূল্যের তথ্য করদাতা কর ফাইলে দেখিয়েছিলেন কি না, কিংবা কম দেখানো হয়েছে কি না, তা জানার পথ সহজ হয়েছে। ইতিমধ্যে ভুয়া ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন (ই-টিআইএন) নম্বর দিয়ে গাড়ি কেনার সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
ওই কার্যক্রমে সফল হওয়ার পর এবার গত ছয় বছরে কর ফাইলে মিথ্যা তথ্য দেওয়া করদাতাদের বিষয়েও একই কায়দায় অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন এনবিআরের আয়কর বিভাগের এ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকতা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা একটি আয়কর সার্কেলেই ১০০টি গাড়ির বিনিয়োগের তথ্যে গরমিল পেয়েছি, যাতে কর ফাঁকির বের হয়েছে পৌনে ৩ কোটি টাকা।'
তিনি আরও বলেন, 'সব মিলিয়ে ৩০০ কর সার্কেলে যদি গড়ে ১০০ করে গাড়ির বিনিয়োগে মিথ্যা তথ্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়, তাতে ৩০ হাজার গাড়িতে এ অনিয়ম বের হবে। এতে আমরা আশা করছি, ৭০০ কোটি টাকার কর ফাঁকি বের হবে।'
তিনি জানান, প্রাপ্ত অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে কর পরিহার করা অর্থ আদায়ে দাবিনামা জারি শুরু আয়কর বিভাগ। দেশব্যাপী পুরো কার্যক্রম শেষে হিসাব চূড়ান্ত করতে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে জানান তিনি।
বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশের সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী, আয়কর ফাইলে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার কারণে আর্থিক শাস্তির পাশাপাশি ফৌজদারি অপরাধেও অভিযুক্ত হতে পারেন ওই করদাতা। ফৌজদারি শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ ৩ মাস থেকে ৩ বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রয়েছে। যদিও এ ধরনের শাস্তির উদাহরণ বিরল।
এনবিআরের আইন অনুসারে, আয়কর বিভাগ করদাতার ওই ফাইল রিওপেন করে যে পরিমাণ বিনিয়োগ গোপন করা হয়েছে, তা তার আয় হিসেবে গণ্য করে এর উপর কর আরোপ করতে পারে। প্রযোজ্য করের পাশাপাশি প্রতি বছরের জন্য ১৫ শতাংশ জরিমানার বিধানও রয়েছে, যা ছয় বছর আগের সময়ের পর্যন্ত আদায় করা যায়।
সূত্র জানায়, গত বছরের শেষ দিকে এনবিআর ১২ লাখ ৮৬ হাজার রেজিস্ট্রেশনের বিপরীতে ই-টিআইএন পরীক্ষা করে ৪ লাখ ৮৫ হাজার গাড়ির ভুয়া টিআইএন চিহ্নিত করে।
এনবিআর সূত্র জানায়, ম্যানুয়াল পদ্ধতির বাইরে গিয়ে এনবিআর এখন ডাটা-ড্রিভেন পদ্ধতির দিকে হাঁটছে। এ লক্ষ্যে বিআরটিএ ছাড়াও সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান শুরু করেছে। এর বাইরে অফিস অভ দ্য রেজিস্ট্রার অভ জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি), সিটি কর্পোরেশনসহ অন্যান্য দপ্তরের কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
কর্মকর্তারা মনে করছেন, এ প্রক্রিয়ায় করদাতাদের আয়করের আওতায় আনা অনেক সহজ হবে।
এনবিআরের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। তিনি বলেন, 'এ কাজটি আরো বহু আগে করা উচিত ছিল, দেরি হয়ে গেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইন্টিগ্রেশনের মাধ্যমে কর ফাঁকি ধরা সহজ এবং এটি ধরার রাইট (অধিকার) এনবিআরের রয়েছে।'
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান দীর্ঘদিন ধরে কর ইস্যু নিয়ে কাজ করছেন। এনবিআরের এমন উদ্যোগকে তিনিস্বাগত জানিয়েছেন। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো গেলে আয়, ব্যয় কিংবা সম্পদের ক্রস চেক করা সহজ হবে, যাতে আরো ভালো সুফল মিলবে।'
দেশে বর্তমানে ই-টিআইএনধারীর সংখ্যা ৬৭ লাখ, যার মধ্যে গত বছর আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন ২২ লাখের মতো।