করোনার হানা: ১২০০ টাকার কাঁকড়া বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিদেশে রপ্তানির বাজার হারিয়েছে কাঁকড়া। বর্তমানে সফট কাঁকড়া রপ্তানি শুরু হলেও তা খুবই সামান্য। তাছাড়া হার্ড কাঁকড়া বর্তমানে বিদেশে রপ্তানি নেই। ফলে কাঁকড়া ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।
রপ্তানি হওয়া বাছাইকৃত কাঁকড়াগুলো বর্তমানে স্থানীয়বাজারগুলোতে বিক্রি হচ্ছে অল্পদামে। তাছাড়া চাহিদা না থাকায় হ্যাচারিগুলোতেও কমেছে কাঁকড়ার উৎপাদন। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা সরকারিভাবে প্রস্তুত হলেও মেলেনি কোনো সহায়তা।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, জেলায় কাঁকড়ার খামারির সংখ্যা ২১৬৮ জন। এ সব খামারিদের কাঁকড়ার চাষ রয়েছে ৩৫২.২৫ হেক্টর জমিতে। কাঁকড়ার বার্ষিক উৎপাদন চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৯৪৫.২২ টন। এ ছাড়া খামারের কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ১৩৪৩ জন পুরুষ ও ১১৫৮ জন মহিলা শ্রমিক। করোনায় কাঁকড়ার ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে ৩২ কোটি দুই লাখ ৯৪ হাজার টাকা।
কাঁকড়ার বড় বাণিজ্যিক বাজার হিসেবে নাম রয়েছে জেলার দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া বাজারের। সেখানে কাঁকড়ার ব্যবসা করেন মিম এন্টারপ্রাইজ নামে একটি হ্যাচারি মালিক আজগর আলী গাজী। করোনাকালীন সময়ে বাজারের দোকানের কর্মচারীদের বেতন দিতে না পাড়ায় প্রতিষ্ঠানটি এখন বন্ধ হয়ে গেছে। তবে নামেমাত্র কাঁকড়া ব্যবসায় জড়িত রয়েছেন এই ব্যবসায়ী। কাঁকড়ার খুচরা ব্যবসা করছেন তিনি।
আজগর আলী গাজী জানান, করোনার কারণে এখন আর কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে না। তাই কাঁকড়ার এখন কোনো মূল্য নেই। গ্রেডের (বাছাইকৃত ভালো কাঁকড়া) ৬-৭ পিসে প্রতি কেজি কাঁকড়া এখন বিক্রি করছি ১৫০-১৭০ টাকায়। একই গ্রেডের কাঁকড়ার মূল্য করোনার আগে ছিল ১২০০-১৫০০ টাকা। কাঁকড়া ব্যবসায়ীরা নিঃস্ব হয়ে গেছে। ব্যবসা না থাকায় কর্মচারীদের এখনও টাকা দিতে পারিনি। পাইকারি ব্যবসা বন্ধ করে এখন খুচরা ব্যবসায় নেমেছি।
পারুলিয়া বাজারের আরেক কাঁকড়া ব্যবসায়ী রুহুল হক। তিনি জানান, কাঁকড়া সব থেকে বেশী রপ্তানি হয় চীনে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ হওয়ার পর এখনও চীনে কাঁকড়া রপ্তানি শুরু হয়নি।
''এক মাস আগে থেকে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ে রপ্তানি হচ্ছে সফট কাঁকড়াগুলো। যা খুবই সীমিত। করোনার আগে ১০ টন কাঁকড়া রপ্তানি হলে এখন হচ্ছে একটন, দামও কম। হাজার টাকার গ্রেডের কাঁকড়ার দাম পাচ্ছি মাত্র ৩০০ টাকা'', যোগ করেন তিনি।
কাঁকড়া ব্যবসায়ী রুহুল হক আরও বলেন, শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ এলাকার খামার থেকে কাঁকড়া এনে বাছাই করে আমরা ঢাকার ব্যবসায়ীর কাছে পাঠাই। সেখান থেকেই মূলত বিদেশে রপ্তানি হয়। এখন বড় সাইজের কাঁকড়া যেমন দুইটায় কেজি, তিনটায় দুই কেজি এমন কাঁকড়া ঢাকাতে পাঠাচ্ছি।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোড়ে কাঁকড়ার বড় হ্যাচারি ফরিদ নাইন স্টার এগ্রো বিডি লিমিটেড। কাঁকড়ার এই বড় হ্যাচারিতে কাজে নিয়োজিত রয়েছেন ৪০০ শ্রমিক। করোনাকালে ব্যবসায়িক ক্ষতির পাশাপাশি কমেছে তাদের নরম খোসার (সফট সেল) কাঁকড়ার উৎপাদনও।
ফরিদ নাইন স্টার এগ্রো বিডি লিমিটেডের ম্যানেজার আমীর হোসেন জানান, করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবের শুরুর পর বিদেশে কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর শুরু হলেও খুব সামান্য সফট কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি করতে পারছি।
তিনি বলেন, করোনার পর রপ্তানি শুরু হলে এখন পর্যন্ত ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও সিঙ্গাপুরে ৬০ টন কাঁকড়া ৮ কোটি ১৭ লাখ টাকায় রপ্তানি করতে পেরেছি। করোনার প্রার্দুভাব না থাকলে আরও ১০০ টন কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হতো।
''রপ্তানি করতে না পারায় আমার ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে অন্তত সাড়ে ১৩ কোটি টাকারও বেশী। চাহিদা না থাকায় হ্যাচারিতে উৎপাদনও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে'', বললেন আমীর হোসেন।
তিনি বলেন, এই ক্ষতি আমরা কিভাবে কাঁটিয়ে উঠবো সেটিও অনিশ্চিত। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও বিবরণ নিয়েছে তবে প্রতিউত্তর কিছু জানায়নি।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, বর্তমানে নরম খোসার কাঁকড়া (সফট সেল) অষ্ট্রেলিয়া, জাপান, তুরষ্ক, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর এসব দেশে রপ্তানি শুরু হয়েছে। তবে হার্ড সেল (শক্ত খোসা) কাঁকড়াগুলো এখনো রপ্তানি শুরু হয়নি। চীন কাঁকড়ার বড় বাণিজ্যিক বাজার। তবে চীনে এখনো রপ্তানি শুরু হয়নি।
তিনি বলেন, করোনার আগে বড় কাঁকড়াগুলো ১২০০-১৪০০ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২৫০-৩০০ টাকায়। বিক্রির পরিমাণও খুম কম।
এই ক্ষতি কাঁটাতে কি ধরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এমন প্রশ্নে মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করে পাঠিয়েছি। তবে এখনও উপর মহল থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।