করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ব্যবসায়িক আস্থার পতন
মার্চের শেষ নাগাদ করোনার অপ্রত্যাশিত আঘাতে পুনরুদ্ধারের পথে থাকা অর্থনীতি ও বাণিজ্য খাতে কমেছে বিজনেস কনফিডেন্স বা ব্যবসায় আস্থা সূচকের মান। ব্যবসায়িক আস্থার এই মান ২০২০ সালের লকডাউন পরবর্তী সময়কালের চেয়েও হ্রাস পেয়েছে।
দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের সাথে মিলিত ভাবে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশে ত্রৈমাসিক ব্যবসায় আস্থা জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে দেখা যায় যে, ২০২০ সালের জুন থেকে বিক্রয়, ব্যবসায় ব্যয়, মজুরি, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ এবং লাভের পরিমাণ মিলিয়ে ব্যবসার সার্বিক অবস্থা ক্রমশ উন্নত হতে থাকে। মার্চের শেষ নাগাদ পর্যন্ত এই ধারা বজায় ছিল।
পরবর্তী তিন মাস ব্যবসায় আস্থা কেমন থাকবে সে বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিদের অংশ নেওয়া জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত ত্রৈমাসিক আস্থার বিষয়টি ইতিবাচক পাওয়া যায়। প্রত্যাশিত অবস্থার চেয়ে অর্থনীতির দ্রুত পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি বাংলাদেশ সফলভাবে টিকাদান কর্মসূচী চালু করায় এসময় আস্থা বৃদ্ধি পায়।
কিন্তু, আরও ভয়াবহ রুপে ভাইরাসের পুনরুত্থান এবং এপ্রিলের সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমাতে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সরকার আরোপিত বিধিনিষেধের কারণে ব্যবসায়িক নীতিনির্ধারকরা এপ্রিল-জুন সময়কালে পরিস্থিতির অবনতি ঘটার আশঙ্কা করেন। ফলে, বিজনেস কনফিডেন্স ইন্ডেক্সের (বিসিআই) রাতারাতি পরিবর্তন আসে।
রবিবার ভার্চুয়াল এক সভার মধ্য দিয়ে সানেম ও দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে "কোভিড-১৯ অ্যান্ড বিজনেস কনফিডেন্স ইন বাংলাদেশ: ফাইন্ডিংস ফ্রম দ্য ফোর্থ রাউন্ড অব আ ন্যাশন ওয়াইড ফার্ম লেভেল সার্ভে" শীর্ষক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে আসে। গবেষণা নিবন্ধে দেখা যায় যে, এপ্রিল-জুন এই তিন মাসে বিসিআই সূচক ৪১ দশমিক ৩৯ শতাংশে নেমে আসে। ২০২০ সালে জুনে এই জরিপ শুরু হওয়ার পর সূচকের মান কখনো ৫০ এর নিচে নামেনি। জানুয়ারি-মার্চ সময়কালে আস্থা সূচকের মান ছিল সর্বোচ্চ ৫৭ দশমিক ৯।
প্রত্যাশা বনাম বাস্তবতা
সানেমের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ডক্টর সেলিম রায়হান ওয়েবিনারে প্রতিবেদনটির মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
ডক্টর রায়হানের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ব্যবসায় প্রথম ধাক্কার পর এপ্রিল-জুন সময়কালের পর থেকেই পরবর্তী তিন মাস নিয়ে আগের তুলনায় ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা বাড়ছিল। ব্যবসা ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার লাভ করতে থাকায় বাস্তব পরিস্থিতিও তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের সময়কালের সাথে এ বছরের একই সময়ের মধ্যকার তুলনায় পাওয়া প্রেজেন্ট বিজনেস স্ট্যাটাস ইনডেক্স (পিবিএসআই) সূচকের মান ৪০ দশমিক ৫৫। অন্যদিকে, গত তিনমাসের সাথে তার আগের তিন মাসের তুলনার পিবিএসআই সূচকের মান ৫০ এর উপরে।
দেশব্যাপী প্রথম লকডাউনের কারণে অধিকাংশ ব্যাবসায়িক কার্যক্রম কমে যাওয়ায় উভয় সূচকের মান গত বছর এপ্রিল-জুন সময়কালে ৩০ এর নিচের ছিল।
একই চক্রের অনুরূপ সময়কালের মধ্যে তুলনায় সূচকের মান ৫০ এর উপর থাকার অর্থ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। অন্যদিকে, মান ৫০ এর নিচে থাকলে পরিস্থিতির অবনতি বোঝায়।
মহামারির মধ্যে প্রথমবারের মতো ব্যবসা সংক্রান্ত আস্থা হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া, এর আগে ভালো পরিস্থিতিতেও ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা করতেন বলে ধারণা করা হয়।
আস্থা কমে যাওয়ার পিছে বাস্তবতার চেয়ে বর্তমানে প্রত্যাশা বেশি থাকাকে প্রধান কারণ হিসেবে ব্যখ্যা করেন ডক্টর রয়হান।
বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ডক্টর জাহিদ হোসেন এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান আলোচনায় বক্তব্য রাখেন। সভায় উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ।
আবারও কমছে পুনরুদ্ধার প্রত্যাশা
বাংলাদেশ করোনার দ্বিতীয় ওয়েভের ঠিক আগে অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ীদের অর্ধেকের বেশি মাঝারিমানের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রত্যাশা করেছিলেন। অন্যদিকে, এক তৃতীয়াংশের বেশি অংশগ্রহণকারীই শক্তিশালী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কথা ভেবেছিলেন।
নতুন ঢেউয়ের উত্থানের পর মাত্র দুই শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন যে এখনো শক্তিশালী পুনরুদ্ধার সম্ভব। অন্যদিকে, ৬৭ শতাংশেরই ধারণা যে জাতীয় অর্থনীতির পুনরুদ্ধার হবে দুর্বল।
সম্ভবত ২০২০ সালের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ব্যবসাগুলোর মহামারি পূর্ব অবস্থায় ফেরত যাবার যে চিত্র পাওয়া যায়, তার কারণেই হতাশাপূর্ণ বক্তব্যগুলো সামনে এসেছে।
জরিপে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো গত এক বছরে মহামারি পূর্ব পর্যায়ে পৌঁছাতে গড়ে মাত্র ৫৭ শতাংশ পর্যন্ত পুনরুদ্ধার লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।
৬ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত জরিপে অংশ নেওয়া ৫০৩টি প্রতিষ্ঠান স্বচ্ছতার সাথে তাদের বিভিন্ন খাত, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, প্রাতিষ্ঠানিক আকার এবং অবস্থান প্রদর্শন করে। এর মধ্যে মাত্র ১৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান মার্চের শেষ নাগাদ করোনা পূর্ব সময়ের তুলনায় ব্যবসায়িক ক্ষতি এড়াতে সক্ষম হয়।
এছাড়া, ১৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কোনো পুনরুদ্ধারের দেখা পায়নি। মার্চের শেষে লকডাউন দেওয়ার আগে যখন সংক্রমণ সংখ্যা বাড়ছিল তখনই প্রায় অর্ধেক প্রতিষ্ঠান আংশিকভাবে চলছিল।
ব্যবসার পরিবেশ সহজীকরণ সূচক
যেসকল উপাদানের উপর ভিত্তি করে ব্যবসাগুলোকে যাচাই করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ব্যয় নিয়ে সবথেকে বেশি উদ্বেগ পরিলক্ষিত হয়। অন্যান্য উপাদানের চেয়ে উল্লেখজনকভাবে ব্যয় সংক্রান্ত মান কম ছিল। বর্তমান ব্যবসায়িক অবস্থা কিংবা আগামী তিন মাস সম্পর্কে প্রত্যাশা উভয় ক্ষেত্রেই বিষয়টি দেখা যায়।
ডক্টর জাহিদসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যবসা পরিচালনার বিশাল ব্যয়ভারের জন্য কেবল মহামারি দায়ী নয়, বরং আমাদের বিদ্যমান ব্যবসায়িক পরিবেশও এর জন্য দায়ী।
জরিপে উন্নত ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করতে ব্যবসায়ীদের কাছে ১০টি নির্দেশকের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। এগুলো হল- বিদ্যুৎ সংযোগ ও মান, দক্ষ শ্রমিকের উপস্থিতি, পরিবহন মান, ব্যবসা কিংবা সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশন, অর্থের সহজলভ্যতা, কর ব্যবস্থা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারি সহযোগিতা, কোভিড-১৯ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য সরঞ্জামাদি এবং দুর্নীতি।
ব্যবসার পরিবেশ সহজীকরণ (ইবিই) সূচকে সবগুলো উপাদান মিলে সূচকের মান বৃদ্ধি পেয়ে ৪৭ হয়। গত তিন ত্রৈমাসিক মেয়াদকালের থেকে এই মান কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু তারপরও ব্যবসা পরিচালনার ব্যয়ভার বড় উদ্বেগের কারণ হিসেবেই থেকে গেছে।
মাত্র ২২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানায় যে তারা সরকারি প্রণোদনা প্রকল্পের আওতায় সুলভ ঋণ পেয়েছেন। প্রণোদনা পাওয়া এই প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত পোশাকশিল্প, টেক্সটাইল, চামড়াশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, আর্থিক খাত এবং ওষুধশিল্প প্রতিষ্ঠানের ন্যায় বৃহদাকার এবং কাঠামোসম্পন্ন খাত।
ক্ষতিগ্রস্ত খাতের তালিকায় শীর্ষে থাকার পরও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, রিয়েল এস্টেট, খুচরা ব্যবসা এবং অন্যান্য প্রস্তুতকারক, পাইকারি ব্যবসা, রেস্তোঁরা, পরিবহনের মতো খাতগুলো মহামারির জন্য সরকারের ঘোষিত সহজ ঋণ প্রকল্পের সামান্যই পেয়েছে।
ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলো সবথেকে বেশি হোঁচট খেয়েছে
মাঝারি এবং বৃহৎ প্রতিষ্ঠান থেকে পিছিয়ে গেছে ক্ষুদ্র ও ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যবসায়িক অবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেদন কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ বা প্রণোদনা গ্রহণ, অথবা স্থিতিস্থাপকতার প্রমাণ- প্রতিটি ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছে এসব প্রতিষ্ঠান।
ডক্টর জাহিদ বলেন প্রণোদনাগুলো মূলত সুপ্রতিষ্ঠিত শ্রমভিত্তিক খাত কেন্দ্রিক। বৃহদাকার প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের অধিকাংশ কর্মসংস্থানের যোগান দিলেও কাঠামোবিহীন এসব প্রতিষ্ঠানের সহায়তা আহ্বানের মতো জোর নেই।
ক্ষুদ্র শিল্পের পাশে দাঁড়াতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গঠন এবং তাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণের আহ্বান জানান ডিসিসিআই সভাপতি।
ডক্টর সেলিমের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে রিজওয়ান রহমান বলেন, প্রতিটি খাতের কাহিনী ভিন্ন। আর তাই তিনি সরকারকে খাতভিত্তিক সহায়ক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।
বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন রিজওয়ান রহমান। এছাড়া, কর ব্যবস্থার পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের উচিত বিদ্যমান করদাতাদের উপর চাপ সৃষ্টি না করে কর খাতের সম্প্রসারণ করা।
অধিক বিনিয়োগ এবং অধিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ফলে ব্যবসায়িক আস্থা আসে বলে তা সাধারণত ইতিবাচক হয়ে থাকে বলে মন্তব্য করেন ডক্টর জাহিদ। তবে মহামারির সময় আস্থা বিপরীত দিকে যেতে পারে, কেননা সংক্রমণ বৃদ্ধির ফলে অন্যান্য জিনিসও ঘটে থাকে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০২২ সালের শেষ নাগাদ হয়তো হার্ড ইম্যুনিটি অর্জিত হবে। ততদিন মহামারি স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটাবে।
সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিষয়ক ব্যবস্থাপনা ও পদক্ষেপকেই করোনা প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি বলে মন্তব্য করেন বক্তারা।