করোনাভাইরাস: অর্ধেকে নেমেছে ঢেউটিন ব্যবসা
পাকা ঘর কিংবা স্থাপনা তৈরির সামর্থ্য নেই- অপেক্ষাকৃত এমন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষজনদেরকেই মূল ক্রেতা মনে করেন ঢেউটিন ব্যবসায়ীরা। তবে করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় ঢেউটিনের ব্যবসায় ধস নেমেছে।
পূর্বের তুলনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঢেউটিন ব্যবসা প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এতে করে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। টাকার অংকে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে কাজ চলছে বলে জানিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি কর্তৃপক্ষ।
তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করছেন- যদিও বেচা-বিক্রি কম থাকায় ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় পাইকারি ও খুচরা মিলিয়ে প্রায় দুইশ ঢেউটিনের দোকান রয়েছে। সকল শ্রেণির মানুষজন ঢেউটিনের ক্রেতা হলেও নিম্ন ও মধ্যবিত্তরাই ঘর-বাড়ি তৈরিতে ঢেউটিনের ব্যবহার বেশি করে থাকেন।
এ ছাড়া স্থাপনা তৈরির খরচ কমাতে গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগির খামার এবং গ্রামাঞ্চলের ঘর-বাড়িতে সীমানা প্রাচীর নির্মাণেও ব্যবহৃত হয় ঢেউটিন। ফলে সারাবছরই জমজমাট থাকে ঢেউটিনের বাজার। তবে চৈত্র ও বৈশাখ মাসে ঢেউটিনের বেচাকেনা সবচেয়ে বেশি হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ঢেউটিনের বেচা-কেনা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাইকারি দোকানগুলোতে প্রতি মাসে গড়ে চারশ থেকে পাঁচশ বান ঢেউটিন বিক্রি হয়। আর খুচরা দোকানগুলোতে বিক্রি হয় দেড়শ থেকে দুইশ বান ঢেউটিন। বাজারে এখন পাইকারি দোকানগুলোতে মানভেদে প্রতি বান ঢেউটিন বিক্রি হচ্ছে ১৭৫০ টাকা থেকে শুরু করে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত। আর খুচরা দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে ১৮৫০ টাকা থেকে ছয় হাজার ১০০ টাকা দরে।
তবে করোনাভাইরাসের কারণে নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরা কর্মহীন হয়ে পড়ায় ঢেউটিন ব্যবসায়ও মন্দাভাব তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও করোনাভাইরাসের উদ্ভুত পরিস্থিতির কারণে গ্রাম-গঞ্জে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি না হওয়ায় ঢেউটিনের ব্যবসাও আগের মতো হচ্ছে না।
ঢেউটিন ব্যবসা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারি নির্দেশনা মেনে গত ২৬ মার্চ থেকে সব দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়। প্রায় তিন মাস বন্ধ রাখার পর দোকান খুললেও বাজারে আগের মতো ক্রেতা নেই। মানুষজনের হাতে টাকা না থাকায় ঢেউটিনের বেচাকেনা অর্ধেকে নেমে এসেছে।
বিক্রি কমেছে অর্ধেক
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে যেসব দোকানে সাড়ে চারশ থেকে পাঁচশ বান ঢেউটিন বিক্রি হতো, এখন একশ থেকে দেড়শ বান ঢেউটিন বিক্রি করতেই বেগ পেতে হচ্ছে। তবে বেচাকেনা কম হলেও, দোকানের খরচ আগের মতোই রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সুহিলপুর গ্রামের বাসিন্দা মোবারক হোসেন জানান, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে থেকে বাড়িতে নতুন ঘর তোলার চেষ্টা করছেন। আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান না হওয়ায় ঢেউটিন দিয়েই ঘর তৈরির পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন ধরে আয়-রোজগার বন্ধ থাকায় এখন ঘর তৈরি করতে পারছেন না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার খুচরা ঢেউটিন বিক্রির প্রতিষ্ঠান রাধা-মাধব ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী প্রিয়তোষ ঘোষ বলেন, পাইকারদের কাছ থেকে এনে আমি খুচরা ঢেউটিন বিক্রি করি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে প্রতি মাসে ২০-৩০ বান ঢেউটিন বিক্রি হতো। এখন গড়ে ১০ বানও বিক্রি হচ্ছে না। ব্যবসার অবস্থা খুবই করুণ।
জেলা শহরের টানবাজার এলাকার সিটি বিল্ডার্সের সত্ত্বাধিকারী রেনিজ রহমান বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে এখন আগের তুলনায় অর্ধেকও বেচাকেনা হচ্ছে না। এখন মাসে গড়ে ৫০ থেকে ১০০ বান ঢেউটিন বিক্রি হচ্ছে।
''বেচা-কেনা কম হওয়ায় খরচ কমানোর জন্য স্থায়ী দুইজন শ্রমিককে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছি। এখন যেদিন বেচা-কেনা হয়, সেদিন বাইরে থেকে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক দিয়ে কাজ করাই'', যোগ করেন তিনি।
''করোনাভাইরাসের কারণে সরকারি নির্দেশনায় প্রায় তিন মাস দোকান বন্ধ রাখতে হয়েছে। ব্যাংকের সুদ মওকুফের কথা বলা হলেও সুদ ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আর ক'দিন পর আমাদের পুঁজির সংকট তৈরি হবে'', বলেন রেনিজ রহমান।
টানবাজারের পাইকারি ঢেউটিন বিক্রির প্রতিষ্ঠান সেলিম ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক আতিকুর রহমান বলেন,
করোনার কারণে আমাদের ব্যবসা প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে গড়ে প্রতি মাসে পাঁচশ বান ঢেউটিন বিক্রি করতাম। এখন মাসে এক-দেড়শ বান ঢেউটিন বিক্রি করতেই কষ্ট হচ্ছে।
তিনি বলেন, ব্যবসা না হলেও দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক সব ব্যয়ই মেটাতে হচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের ব্যাংক ঋণের সুদও নিয়মিত পরিশোধ করতে হচ্ছে।
ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের কাজ চলছে
ব্রাহ্মণবাড়িয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আজিজুল হক বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে রড, সিমেন্ট ও ঢেউটিনের ব্যবসা অর্ধেকে নেমে এসেছে। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে নিরূপণ করা হবে, যা চলমান রয়েছে।
''করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফের বিষটি ব্যংক কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করছে না। এ ছাড়া চার শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়ার বিষয়টিও কয়েকটি ব্যাংক ছাড়া বাকিগুলো মানছে না'', যোগ করেন তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যাংকার্স ফোরামের সভাপতি ও সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রধান শাখার ব্যবস্থাপক ইকবাল হোসেন ভূইয়া বলেন, সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া খাতের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরাই কেবল চার শতাংশ হারে প্রণোদনা ঋণ পাবেন। আর করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো ব্যবসায়ী যদি এসে ক্ষতির কথা বলেন, তাহলে তার সুদ মওকুফ হবে। কিন্তু আমাদের কাছে এমন কেউই আসেননি।
নেত্রকোনায় ঢেউটিন ব্যবসায় ক্ষতি ছয় কোটি টাকা
জেলা সদরের ছোটবাজারের 'হাসেম ট্রেডার্স' এর মালিক তামিম আহমেদ বলেন, সাধারণত বর্ষা শুরুর আগে ঢেউটিনের ভালো বেচাবিক্রি হয়। কিন্তু এ বছর ওই সময়টাতে দোকান বন্ধ রাখতে হয়েছে। এর ফলে ঢেউটিন ব্যবসায়ীরা প্রত্যেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
জেলা রড, সিমেন্ট ও ঢেউটিন ব্যবসায়ী সমিতি'র সাধারণ সম্পাদক সুভাষ ভদ্র বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ মানুষের আয়রোজগার কম। এ কারণে বাড়িঘর নির্মাণের কাজও কম হচ্ছে। তাই ঢেউটিনের ব্যবসাও মন্দা যাচ্ছে। জেলায় গত পাঁচ মাসে ঢেউটিন ব্যবসায় ছয় কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে।
লোকসানে দিনাজপুরের ব্যবসায়ীরা
দিনাজপুর শহরের মুন্সিপাড়া ব্রাদার্স করপোরেশনের সত্বাধিকারী শাহীন হোসেন বলেন, করোনার কারণে গত বছরের তুলনায় চলতি বছর ব্যবসা কমেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। ব্যবসা কমায় লোকসান না হলেও লাভ তেমন হচ্ছে না। একই চিত্র জেলার সকল ব্যবসায়ীদের বলে দাবি করেন তিনি।
- প্রতিবেদনটি করতে আমাদের দিনাজপুর ও নেত্রকোনা প্রতিনিধি সহযোগিতা করেছেন।