করোনাকালেও ভালো করছে নতুন প্রজন্মের ব্যাংক
করোনা ভাইরাসের প্রভাব দেশের প্রতিটি খাতে স্থবিরতা এনে দিয়েছে। অর্থনীতিতে এসেছে নানা পরিবর্তন। ঋণ প্রবাহ কম থাকায় ব্যাংকগুলো আমানতের টাকা বিনিয়োগ করতে পারছে না। এ কারণে দীর্ঘদিন যাবৎ তফসিলি অধিকাংশ ব্যাংক আশানুরূপ মুনাফা পায়নি। তবে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোতে বাড়ছে ঋণ বিতরণ এবং আমানতের পরিমাণ। একইসঙ্গে খেলাপি ঋণ, প্রভিশন সংরক্ষণ, সম্পদের বিপরীতে আয় ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের অনুপাত (সিআরএআর) সহ ২০২০ সাল শেষে সবকটি সূচকে তারা ভালো করেছে ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকের মোট সম্পদের ৪.৯ শতাংশ এখন নতুন প্রজন্মের ১২ ব্যাংকের দখলে। এসব সম্পদের মধ্যে ঋণ এবং অগ্রিম প্রায় ৭০ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৯ সালের তুলনায় খেলাপির হার কমে ২০২০ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।
রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অনুমোদন দেওয়া হয় চতুর্থ প্রজন্মের ১২টি নতুন ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্যোগে এনআরবি, এনআরবি গ্লোবাল ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। বাকি নয়টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। এগুলো হলো- ইউনিয়ন, মেঘনা, মিডল্যান্ড, মধুমতি, পদ্মা সাবেক (দ্য ফারমার্স),সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স, পুলিশ কমিউনিটি ও সীমান্ত ব্যাংক।
চলতি বছরে নতুন করে এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক। এগুলোর মধ্যে একটি শরীয়াহ ভিত্তিক, একটি বিশেষায়িত এবং বাকি দশটি প্রচলিত ব্যাংকিং সেবা প্রদান করছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংকগুলোর মোট সম্পদের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। এখন ব্যাংক সম্পদের ৪.৯ শতাংশ নতুন ব্যাংকের দখলে থাকলেও ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৪.৮ শতাংশ। একইসঙ্গে নতুন ব্যাংকগুলোর ঋণ ও অগ্রিম ২০১৯ এর তুলনায় দশমিক তিন শতাংশ বেড়ে ৫.৪ শতাংশে পৌঁছেছে। কারণ সে সময় ঋণের হার ছিল ৫.১ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী নতুন এ ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের চিত্র সার্বিক ব্যাংকিং খাতের তুলনায় কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে। ২০২০ এর ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর মোট সম্পদের মধ্যে ঋণের অংশ ছিল ৬৯.২০ শতাংশ। তবে আগের বছর এর হার ছিল ৭১.৭০ শতাংশ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের মোট খেলাপির পরিমাণ ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা, যা তাদের মোট বিতরণকৃত ঋণে্র ৮.১৮ শতাংশ। তবে নতুন প্রজন্মের এ ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অনেকটা সতর্ক ছিল। ভালো গ্রাহককে ঋণ দেওয়ায় এর খেলাপি অন্য সকল ব্যাংকগুলোর তুলনায় অনেকটা কম। বর্তমানে নতুন এ ব্যাংকগুলোর খেলাপি রয়েছে বিতরণকৃত ঋণের ৭.৮ শতাংশ। যদিও ২০১৯ এর ডিসেম্বর শেষে সকল তফসিলি ব্যাংক ও নতুন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৯.৫ শতাংশ এবং ৯.৩ শতাংশ।
নতুন ব্যাংকগুলোর প্রভিশন সংরক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, একটি ব্যাংক ব্যতীত ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ অন্যান্য ব্যাংক সফলভাবে প্রভিশন সংরক্ষণ করে।
এছাড়া নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর সম্পদের বিপরীতে আয় রিটার্ন অন অ্যাসেটস (আরওএ) সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ২০২০ সালে ব্যাংক খাতের (০.৩ শতাংশ) তুলনায় নতুন ব্যাংকগুলোর (০.৯ শতাংশ) আরওএ অনেক বেশি। একটি ব্যাংক ছাড়া নতুন ব্যাংকগুলোর মুনাফা প্রবণতা ভালো ছিল।
নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুনত্ব আনতে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ব্যাংকটি পুরোনো ব্যাংকগুলোর মতোই আমানত সংগ্রহ করে ঋণ প্রদান করছে। ২০২০ এর ৩০ জুন শেষে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণ ও অগ্রীমের পরিমাণ ৫ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির শহরে ও গ্রামে ৮৩টি শাখা ও ১৪টি উপশাখায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোসলেহ উদ্দীন বলেন, "অধিকাংশ ব্যাংক কর্পোরেট ঋণে ঝুকছে। আমরা কিছুটা ভিন্নতা এনে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করছি। কৃষিখাতে গত বছরে লক্ষ্যমাত্রার বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। চলতি বছরেও আশা করছি লক্ষ্যমাত্রার বেশি কৃষি ঋণ দিতে পারব। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সেবা দিতে আমরা গ্রামীণ পর্যায়ে শাখা খুলেছি। অনলাইন ব্যাংকিংও চালু করেছি। আগামী অক্টোবর থেকে এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করব। বিশেষ করে, আমাদের ব্যাংকটি ক্ষুদ্র অঙ্কে ভাগ করে অধিক গ্রাহককে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছে।"
চতুর্থ প্রজন্মের আরেকটি ব্যাংক এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংক। ২০১৩ সালের এপ্রিলে ব্যাংকটির যাত্রা শুরু। যাত্রা শুরুর চার বছরেই নানা অনিয়মে ধুঁকতে থাকা এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় ২০১৭ সালের ডিসম্বরে ঢেলে সাজানো হয়। ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ফরাসত আলী পদত্যাগ করার পর ওই দায়িত্ব নেন এসএম পারভেজ তমাল। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর ব্যাংকটি ধীরে ধীরে ঘুরে দাড়ায়।
ব্যাংকটিতে বর্তমানে ১০ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকার ওপর আমানত রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা ঋণ ও আগ্রীম রয়েছে। শহর ও গ্রামে ৮৩টি শাখায় তাদের কার্যক্রম চলছে। ৪৫০টি উপশাখা রয়েছে ব্যাংকটির, যা সব ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়াও শরীয়াভিত্তিক ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডো 'আল আমিন ব্যাংকিং' চালুর মাধ্যমে সব শাখা ও উপশাখায় সেবা দেওয়া হচ্ছে।
ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) গোলাম আউলিয়া বলেন, "এনআরবিসি ব্যাংকের মূল লক্ষ্য জনগণের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করা। এজন্য প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন সেবা চালু করেছি। নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে আমানতের ক্ষেত্রে আমরা রেকর্ড পর্যায়ে রয়েছি। গ্রুপ করে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য অমরা মাইক্রো ফাইন্যান্সিংয়ের আওতায় ঋণের ব্যবস্থা করেছি। একইসঙ্গে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানে এনজিওর মাধ্যমে আমাদের ফান্ডিং করছি।"
"গ্রামীণ পর্যায়ে আমাদের সেবা সফলভাবে দেওয়া হচ্ছে। গ্রাহকরা আমাদের প্রতি অগাধ আস্থা রেখে সেবা নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা কেউ ঘরহীন থাকবে না। সে লক্ষে যার ছোট ছোট বাসা বাড়ি করে তাদেরকে ঋণ দিচ্ছি। সামনে আমাদের নেটওয়ার্ক বাড়াতে নতুন সেবা আনতে যাচ্ছি । মানুষের অর্থের নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করা হচ্ছে। আবার সেই অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করে সারা দেশের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বিভিন্ন প্রয়োজন মেটানো হচ্ছে। এজন্য আমানত সংগ্রহের পাশাপাশি আমরা ঋণদান কার্যক্রমও জোরদার করেছি," বলেন তিনি।