এক্সক্লুসিভ: প্লাস্টিক কারখানার সবুজযাত্রা

১ লাখ ২৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন সৈয়দ নাসির। ২৯ বছরের ব্যবধানে তার প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বিক্রয় এখন ১৫২ কোটি টাকা। কর্মসংস্থান করেছেন প্রায় ১ হাজার ২০০ কর্মীর।
১৯৯২ সালে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে প্রথম রংয়ের টিনের কৌটা বানানোর মাধ্যমে যাত্রা শুরু। এখন টঙ্গী বিসিকে একটি এবং গাজীপুরে ২টি, সব মিলিয়ে মোট চার কারখানার মালিক তিনি।
এরপরও চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় আরো দুটি কারখানা তৈরির কাজ হাতে নিয়েছেন। এরমধ্যে গাজীপুরের নতুন প্লান্টটিতে কাজের অনুমতি পেলেই উৎপাদন শুরু করবেন।
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরের অপর কারখানার জন্য ৫ একরের সবুজ কারখানা তৈরীর জন্য জমি বরাদ্দ চেয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে তার প্রতিষ্ঠান। সেখানে প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে।
সম্প্রতি গাজীপুরে 'এক্সক্লুসিভ ক্যান লিমিটেড' কারখানা ঘুরিয়ে দেখালেন সৈয়দ নাসির নিজেই; জানালেন কারখানা গড়ে তোলার আদ্যোপান্ত।
স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎপাদন
ঘুরে দেখা যায়, এ কারখানাতে কর্মরত আছেন ৭৫০ জন শ্রমিক। বাইরে রোদের প্রচন্ড তাপদাহ ছিল। কিন্তু কারখানার ভেতরে তা বোঝার কোন উপায় নেই।
পরিবেশবান্ধব এ কারখানায় নেই কোন এসি। এমনকি শ্রমিকদের মাথার উপর নেই বৈদ্যুতিক পাখা। তারপরেও কারখানার ভেতরে গরম অনুভূত হচ্ছিল না। প্রকৃতিবান্ধব প্রযুক্তির সহায়তার আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে কারখানায়।
এক্সক্লুসিভ ক্যান লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসির বলেন, "এগজস্ট ফ্যান ব্যবহার করায় বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে ভেতরের তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি শীতল থাকে। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পেতে ভবনের নিচতলায় ছাদের উচ্চতা ২০ ফুট করা হয়েছে। অন্যান্য ফ্লোরের উচ্চতা ১৮ থেকে ১৬ ফুট। সবুজ কারখানার সব শর্ত মেনে এটি তৈরী করা হয়েছে। কমপ্লায়েন্স কারখানা নির্মাণে আমাদের বিনিয়োগ প্রথমে বেশি হলেও দীর্ঘমেয়াদে লাভ রয়েছে"।
৪৩ হাজার ২০০ বর্গফুট জায়গার মধ্যে ২৫ হাজার বর্গফুট জায়গায় হয়েছে গ্রিন কারখানা এক্সক্লুসিভ ক্যান লিমিটেড। দৃষ্টিনন্দন এই ভবনের খালি জায়গায় রয়েছে বিভিন্ন বৃক্ষের সমারোহ।
এখানেই অটো ওয়েল্ডিং মেশিনে কাজ করেন অনন্ত তালুকদার। তিনি টিবিএসকে বলেন, "কারখানায় কখনও শরীর ঘামে না। এত খোলামেলা জায়গায় কাজ করতে একঘেঁয়েমিও লাগে না"।
এই কারখানায় নেই বৈদ্যুতিক তারের দৃশ্যমান ব্যবহার। বাসবার ট্রাঙ্কিং সিস্টেম (বিবিটি) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এতে করে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট হয়ে আগুন লাগার সম্ভাবনা নেই।
কোন কারণে আগুন লাগলেও উত্তাপ ও ধোঁয়ার উপস্থিতি বুঝে নেয়ার স্বয়ংক্রিয় কার্যক্রম শুরু হবে। আর আগুন লাগার পরও অন্তত দেড় ঘন্টা থাকবে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা।
সিলিংয়ের অংশে স্বয়ংক্রিয় পানির লাইন রয়েছে, আগুন লাগলে পানি বের হবে। দরজাগুলো এতটাই প্রশস্ত যে কারখানায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেও শ্রমিকরা সহজেই বাইরে বের হতে পারবেন।
কারখানার মেঝেতে বসানো হয়েছে উন্নতমানের পলিইউরেথিং পুডিং, যা পণ্যের গুণগত মান অটুট রাখছে। সেই সঙ্গে উৎপাদিত পণ্যকে ময়লা ও জীবাণুমুক্ত রাখছে।
এক্সক্লুসিভ ক্যান লিমিটেড কারখানায় তৈরী হয় রংয়ের ছোট-বড় প্লাস্টিকের ক্যান, আইসক্রিমের বক্স, মবিলের ক্যান, ওষুধ এবং খাদ্যদ্রব্যের কৌটা। নিচতলায় তৈরী হয় বিভিন্ন আকারের টিনের কৌটা।
তাছাড়া এ কারখানায় ব্যবহার করা হয় অর্ধশতাধিক রোবটসহ অত্যাধুনিক চীনা প্রযুক্তির মেশিনারিজ।
পেইন্ট খাতে এ কোম্পানির অনেক গ্রাহক রয়েছে- বার্জার, এশিয়ান, নিপ্পন, ড্যুলাক্স, এলিট। তালিকায় রয়েছে আইসক্রিম তৈরির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামও- সেভয়, পোলার, কোয়ালিটি, লাভেলো।
ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে রেডিয়েন্ট, পপুলার, এসিআই ফার্মা থেকে শুরু করে আড়ং, মিল্কভিটা সহ ৩৯টির মত প্রতিষ্ঠান তাদের গ্রাহক।
সৈয়দ নাসির বলেন, "আমরা পণ্যমান সঠিক রাখতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে মেঝেতে পলিইউরেথিন (পিইউ) কালারের কোট ব্যবহার করি।
আমাদের বক্সে অনেকে খাবার রপ্তানিও করছে। তাই আমরা ফুড গ্রেড প্লাস্টিক ব্যবহার করি। এখন লুব্রিকেন্ট বা আইসক্রিম সেক্টরে প্যাকেজিংয়ে পরিবর্তন এসেছে। আমরা তাই খাদ্যের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যগত দিক এসবে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি"।
গাজীপুরের ৫ তলা কারখানা ভবনটি তৈরীতেই ৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন সৈয়দ নাসির। ২০১৬ সালে শুরু হয়ে এর কাজ শেষ হয় ২০১৯ সালের শেষের দিকে।
এর মধ্যে কারখানা বানাতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
সৈয়দ নাসির বলেন, "কারখানা কোন গোডাউন না; বরং কারখানার অর্থ যেখানে রোদ ,বৃষ্টি, বাতাস খেলা করবে। প্রকৃতির এ সুবিধা আমাদের ব্যবহার করতে হবে"।
কারখানা ঘুরে দেখা গেল আমদানি করা প্লাস্টিক রেসিন (প্লাস্টিক দানা) থেকে তৈরী হচ্ছে বিভিন্ন আকারের ক্যান, আইসক্রিমের বাক্স। উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়াই হচ্ছে রোবটের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। একদিক নিয়ে নলের মাধ্যমে প্লাস্টিক রেসিন প্রবেশ করছে মেশিনে, সেখানে থেকে বক্স তৈরী হয়ে বের হচ্ছে। এরপর শুধু বক্সটি সরিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখছেন কর্মীরা। সেখানেও গ্লাভস ব্যবহার করছেন তারা।
সৈয়দ নাসির জানান, কারখানায় উন্নতমানের মেশিন কেনায় খরচ হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। কোনপ্রকার হাতের স্পর্শ ছাড়াই এসব প্লাস্টিক ক্যান তৈরি হয়।
সৈয়দ নাসির বলেন, কারখাগুলোতে প্রতিমাসে ৫০০ মেট্রিক টনের বেশি প্লাস্টিক রেসিন প্রয়োজন হয়। আর টিনের কৌটা তৈরী করতে প্রতিমাসে ৩০০ মেট্রিক টন টিন প্লেট ও ইলেকট্রোলাইট টিন প্লেটের প্রয়োজন হয়।
একাডেমিক সার্টিফিকেট বন্ধক রেখে ঋণ
চট্টগ্রামের সন্তান সৈয়দ নাসির বাবার পেনশনের টাকা থেকে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা নিয়ে ১৯৯২ সালে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে প্রথম বার্জার রংয়ের টিনের কৌটা বানানো শুরু করেন। বার্জার পেইন্টসের 'ভেন্ডর' হিসেবে রঙের কৌটা বানাতেন তিনি।
সৈয়দ নাসিরকে ব্যবসা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তখনকার বার্জারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রেজাউল করিম।
সৈয়দ নাসির বলেন, "ঢাকায় চাকরির সন্ধানে ট্রেনে আসছিলাম, তখন ট্রেনেই পরিচয় হয় বার্জারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রেজাউল করিমের সঙ্গে। তার পরামর্শ ভালো লাগে আমার। যেহেতু উৎপাদিত পণ্য বিক্রির নিশ্চয়তা ছিল তাই শুরু করে দিলাম। তখন প্রতিষ্ঠানে ২০ জন শ্রমিক ছিল। ওই সময়ে টিনের ক্যান তৈরি করে বার্জারকে সরবরাহ করি। আর বার্জারের কারখানাও ছিল চট্টগ্রামে। তাই সুবিধা হলো আমার"।
পরে চট্টগ্রামে সোনালী ব্যাংকের পাঁচলাইশ শাখায় একাডেমিক সার্টিফিকেট বন্ধক রেখে ৫ লাখ টাকা ঋণ পান নাসির। আরও ১৫ লাখ টাকা পান প্লেজ (গুদামজাত পণ্যের বিপরীতে দেওয়া ঋণ) ঋণ হিসেবে।
সৈয়দ নাসির বলেন, "ব্যাংকের এই উদ্যোগ আমাকে সহায়তা করেছে ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করতে। এরপর ১৯৯৯ সালে ৫৫ লাখ টাকা ঋণ নেই সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে। ওই টাকায় চট্টগ্রামের কারখানার পাশে ৪ তলা ভবন কেনা হয়।
২০০০ সালের দিকে ঢাকার বাজার ধরতে রাজধানীর সাভারে কারখানা করেন নাসির। ৩ বছর ভাল চললেও এরপর শুরু হয় চ্যলেঞ্জ। এ সময় টিনের ক্যান এর চাহিদা কমে যায়। রংয়ের কোম্পানিগুলো প্লাস্টিক ক্যান ব্যবহার বাড়াতে থাকে।
প্লাস্টিক ক্যান বানাতে খরচ বেশি তাই ঢাকা ছেড়ে চলে যান চট্টগ্রামে। টিনের কৌটার পাশাপাশি চট্টগ্রামে প্লাস্টিকের ক্যান বানানো শুরু করেন।
২০০৬ সালে আবার ঢাকায় আসেন সৈয়দ নাসির। টঙ্গী ব্রিজের কাছে কারখানা চালু করেন। তখন এশিয়ান পেইন্টসের রংয়ের ক্যান তৈরী করেন। এরপর ব্যবসা লাভজনক হলে ২০১০ সালে কারখানা স্থানান্তর করেন টঙ্গীর বিসিকে। এরপর প্রায় সব রং কোম্পানি তার গ্রাহক হয়ে যায়। কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানও তার ক্যান নিতে থাকেন। ব্যবসা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে।
২০২০- ২০২১ অর্থবছরে ১৫২ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে সৈয়দ নাসিরের প্রতিষ্ঠান থেকে। এর আগের অর্থবছরে ১০৩ কোটি টাকা বিক্রি হয়েছে।
সৈয়দ নাসির বলেন, "পেইন্ট সেক্টরে রংয়ের প্লাস্টিকের ছোট-বড় ক্যানের মার্কেট রয়েছে ২১০ কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে আমরাই ১২০ কোটি টাকার পণ্য সরবরাহ করি। আইসক্রিমের বক্সের মার্কেট রয়েছে ৩৫ কোটি টাকার। এরমধ্যে ১২ থেকে ১৪ কোটি টাকার পণ্য আমাদের প্রতিষ্ঠান তৈরী করে"।
প্লাস্টিকের রিসাইক্লিং পণ্য তৈরীতে আগ্রহী
প্লাস্টিক পচে না। তাই এ পণ্য রিসাইক্লিং করতে চান সৈয়দ নাসির। তিনি বলেন, "সরকারকে প্লাস্টিক বর্জ্যের স্থায়ী, উন্নত ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা করতে হবে। এটা করা হলে আমরা সহজেই এ প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করতে পারবো"।
তিনি বলেন, "আমাদের কাছে বিদেশি বায়ার আসে। তারা বলে, তারা আমাদের অর্ডার দেবে যদি আমরা আমাদের স্থানীয় পণ্যগুলোর ২৫% পুনর্ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু আমরা তাদের শর্ত পূরণ করতে পারি না কারণ বিক্রি হওয়া পাত্র রিসাইক্লিং করা কঠিন। মানুষ সাধারণত রংয়ের কৌটাগুলো পানির পাত্র বা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করে"।