ঈদের আগে শঙ্কায় জুতা ব্যবসায়ীরা
জুতা শিল্পে বছরজুড়ে বিক্রয়ের এক-তৃতীয়াংশ পণ্যই বিক্রি হয় রমজানের ঈদকে ঘিরে। আর এই সময়ে জমজমাট ব্যবসার আশায় জুতা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি থাকে তুঙ্গে।
কঠোর লকডাউনে গত বছরের মতোই এবারও জুতা শিল্পে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ব্যবসায়ীদের আশায় অনেকটাই গুড়েবালি।
ঈদকে ঘিরে পিক টাইমে যখন পণ্য বিক্রির মৌসুম, তখন দোকানপাট বন্ধ থাকায় ঘরবন্দী জুতা ব্যবসায়ীরা।
দেশে ব্র্যান্ডেড ও নন-ব্র্যান্ড মিলে পাঁচ শতাধিক জুতা উৎপাদনকারী কোম্পানী ব্যবসা করে। ব্র্যান্ডের জুতা কোম্পানী এক থেকে দেড় ডজন হলেও বাজার দখলে রেখেছে নন-ব্র্যান্ডের কোম্পানীই। এসব কোম্পানীগুলোতে নারী-পুরুষ মিলে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান।
ব্র্যান্ডেড জুতার মধ্যে বিদেশী বাটা সু কোম্পানীর ব্যাপক আধিপত্য থাকলেও গত কয়েক দশকে দেশীয় ব্র্যান্ডের এক ডজনের মতো কোম্পানী গড়ে উঠেছে, যারা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সক্ষম।
বিগত বছরগুলোতে স্বাভাবিক সময়ে মানুষের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জুতার বাজার। করোনা মহামারী সংকট তৈরীর আগে গড়ে ১২-১৫% পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
করোনার আঘাতের পর ২০২০ সালে আগের বছরের সমান প্রবৃদ্ধি হয়নি। এবার ক্ষতি কাটিয়ে উঠার চেষ্টায় ছিলেন ব্যবসায়ীরা।
ব্র্যান্ডের জুতা তৈরীকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- বাতা, এ্যাপেক্স ফুট ওয়্যার, ফরচুন শ্যুজ, ফরচুনা, বে, হামকো, জেনিস, ক্রিসেন্ট, ভাইব্র্যান্ট, লেথেরেক্স, এসটিইপি, ওয়াকার, ওরিওন, ফ্যালকন, জেইলস, শামপান ইত্যাদি।
পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডগুলো বছর জুড়ে নিজস্ব আউটলেটে পণ্য বিক্রি করলেও নন-ব্র্যান্ডের ছোট কোম্পানীগুলো বিভিন্ন উৎসব ঘিরে ব্যবসা করে।
ছোট ব্যবসায়ীরা গত বছরের মতো এবারও ঈদ উৎসবে শঙ্কার মধ্যে পড়েছে। ক্ষতি কাটানোর আশায় নতুন করে পুঁজি খাটিয়ে শঙ্কায় নন-ব্র্যান্ডের জুতা উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীরা।
পণ্য রপ্তানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারে সুপরিচিত নাম এ্যাপেক্স ফুটওয়্যার। সারাদেশে কোম্পানীটির দুই শতাধিক আউটলেট রয়েছে। গতবছর করোনায় তারা ব্যবসা করতে পারেনি।
এবার পিক মৌসুমে পণ্য বিক্রির সময় করোনার হানায় ব্যবসা নিয়ে শঙ্কিত প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। কারণ প্রতিষ্ঠানটি বছরজুড়ে পণ্য বিক্রির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করে, তার ৩০-৪০% পহেলা বৈশাখ ও ঈদ-উল-ফিতরে বিক্রি হয়।
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের কোম্পানী সেক্রেটারি মোঃ ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, "পণ্য রপ্তানির চিত্র ভালো না, স্থানীয় বাজারের ব্যবসা দিয়েই টিকে ছিলাম। কিন্তু ব্যবসার পিক টাইমে দুই সপ্তাহ লকডাউন। দোকান খুলতে পারছি না। কিভাবে আমরা টিকে থাকব, সেটা বুঝতে পারছি না।"
"ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। গত বছর ব্যবসায় হয়নি। বড় লোকসান হয়েছিল। মনে করেছিলাম ক্ষতিটা কাটিয়ে উঠতে পারব। কিন্তু পিক টাইমে লকডাউন আরও বেশি ক্ষতি বয়ে আনবে। কারণ ঈদ উৎসবকে ঘিরে প্রস্তুতি ছিল। সেই পণ্যের মজুত এখন আমরা কী করব?"
মোঃ ওমর ফারুক বলেন, "শুনছি, ঈদের আগে সপ্তাহখানেক মার্কেট খুলবে কিন্তু সে সময়ে ব্যবসা কতটা হবে সেটাও প্রশ্নের বিষয়। কারণ মানুষ অনেকে বাড়ি চলে গেছে। ঘর থেকে বের হতে না পারলে পণ্যও কিনতে পারবে না"।
"শপিং মল খুললেও যদি সময় বেঁধে দেয়, তাহলে তো কিছুই হবে না। কারণ দুপুরের পর থেকে মানুষ ঘর থেকে বের হয়, সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত পণ্য কেনে কিন্তু আগেই যদি সবকিছু বন্ধ করে দিতে হয়, তাহলে ব্যবসার কিছুই হবে না," যোগ করেন তিনি।
ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা, কিন্তু আবার আঘাত
গত লকডাউনে ঈদ মৌসুমে ব্যবসা করতে পারেনি ব্যবসায়ীরা। দোকানপাট বন্ধ ছিল। আউটলেট খোলা যায়নি দুইমাসের বেশি সময়।
মানুষ ঘর থেকে বের হতে না পারায় উৎপাদিত পণ্যও বিক্রি করতে পারেনি ব্যবসায়ীরা।
লকডাউন তুলে নেওয়ার পর জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষ ঘর থেকে বের হতে শুরু করলে স্বাভাবিক হতে শুরু করে জুতা বা ফুটওয়্যার শিল্প।
এতে লকডাউনে বিক্রি একদম শূণ্যে নামলেও ২০২০ সালের শেষ নাগাদ জুতা শিল্প স্বাভাবিক সময়ের মতো গতি ফিরে পায়।
কিন্তু জুতা শিল্পে আবারও সেই পুরনো শঙ্কা উঁকি দিচ্ছে। দ্বিতীয় দফা লকডাউনে থমকে গেছে সবকিছু। লোকসানের ভয়ে জুতা শিল্পের ব্যবসায়ীরা।
গত ১৪ এপ্রিল থেকে চলছে এক সপ্তাহের সর্বাত্মক লকডাউন। জরুরী সেবার সাথে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় সবকিছুই বন্ধ। আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত সর্বাত্মক লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এর আগে গত ৫ এপ্রিল থেকে পালিত হয়েছে সীমিত লকডাউন।
ব্যবসায়ীরা জানান, আগের বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশায় এবার তাদের ভালো প্রস্তুতি ছিল। আগের বছরের উৎপাদিত পণ্য কমমূল্যে বিক্রি করেও ঈদ উৎসবকে ঘিরে প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
জুতা শিল্পের দেশীয় উদ্যোক্তা কোম্পানী নাজ সুজ। সারা দেশে প্রতিষ্ঠানটির সাড়ে তিনশ রিটেইল আউটলেট রয়েছে।
করোনার কারণে গত ঈদে নাজ সুজ ব্যবসা করতে পারেনি। এবার তাদের ভালো প্রস্তুতি থাকলেও লকডাউনের কারণে ব্যবসা নিয়ে শঙ্কায় প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্টরা।
নাজ সুজের স্বত্বাধিকারী মোঃ সাইফুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ঈদ মৌসুম জুতা বিক্রির পিকটাইম। গতবছর ঈদে লকডাউন ছিল। ব্যবসা করতে পারিনি। মানুষ যখন কেনাকেটা করে, সে সময়টায় সবকিছু বন্ধ ছিল। এবছরও একই অবস্থা তৈরী হয়েছে।"
তিনি বলেন, "এই পিক টাইমে সাড়ে তিনশ'র বেশি রিটেইল আউটলেট বন্ধ রয়েছে। তবে ব্যবসা সচল থাকার উপর ভিত্তি করে ক্যাপাসিটি ঋণ নেওয়া হয়। ব্যবসা বন্ধ থাকলেও ঋণ নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। আবার কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।"