ইভ্যালি থেকে আলেশা মার্ট: পঞ্জি স্কিম পতনের কাহিনী
চলতি বছরের মাঝামাঝি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের ছদ্মবেশে আসা পঞ্জি ব্যবসাগুলো একের পর এক ধসে পড়তে থাকে। গ্রাহকরা যখন পাওনা টাকা ফেরত পেতে ছোটাছুটি করছেন তখন আরেক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম নিজেদের ব্যতিক্রমী প্রমাণের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আসলে সেই প্রতিষ্ঠানের পতনও ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার।
'পরবর্তী নির্দেশনা' না দেওয়া পর্যন্ত বৃহস্পতিবার দাপ্তরিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম আলেশা মার্ট। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মঞ্জুরুল আলম সিকদার। তার মালিকানাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আলেশা মার্টের কার্যক্রমে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে একসময় প্রতিষ্ঠানটি দাবি করে।
এদিকে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে গত তিন মাস ধরে বেতন না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন আলেশার চার কর্মী।
আলেশা গ্রুপের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এক ডজনের বেশি। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিয়মিত মুনাফা অর্জন করায় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে কয়েকশ কোটি টাকার ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে বলে দাবি করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার।
বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে প্ল্যাটফর্মটি ৩২ কোটি ৫৫ লাখ টাকায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হওয়ার পাশাপাশি ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসানকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করে নিয়মিত আকর্ষণীয় সব বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করে।
গতকাল বৃহস্পতিবার আলেশা মার্ট 'বহিরাগত' কয়েকজনের বিরুদ্ধে অফিস কর্মকর্তাদের গায়ে হাত তোলার অভিযোগ আনে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরই পুনরায় কার্যক্রম শুরু হবে বলে প্রতিষ্ঠানটি ঘোষণা দেয়।
এখন প্রশ্ন হলো গ্রাহকরা কেন ক্ষুদ্ধ?
গ্রাহকদের অভিযোগের কারণগুলোও বেশ পরিষ্কার। ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও পাঁচ মাস পরেও গ্রাহকরা পণ্য পাননি। অন্যদিকে তাদের অগ্রীম পরিশোধিত অর্থও প্রতিষ্ঠানটি ফেরত দেয়নি।
আলেশার চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম সিকদার দাবি করেন তার প্রতিষ্ঠানটি ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। আলেশা মার্ট গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধের আন্তরিক চেষ্টা চলছে বলেও তিনি দাবি করেন।
বৃহস্পতিবার ফেসবুক লাইভে এসে তিনি আগামী ৩০ জানুয়ারির ভেতর গ্রাহকদের সকল পাওনা অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
ব্যাংকে আছে মাত্র ২ কোটি টাকা
আলেশা মার্টের ব্যাংক হিসাব জব্দ হওয়ার পরেও কয়েক হাজার গ্রাহক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অর্থ ফেরত পাওয়ার আশা করছিলেন।
ইভ্যালি, ধামাকা শপিং, ই-অরেঞ্জ, কিউকুম এবং অন্যান্য ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম নিয়ে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে অনেক প্ল্যাটফর্মই মালিকদের স্বার্থে গ্রাহকের টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এছাড়া, অর্থ সংকটের কারণেও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এবার আলেশা মার্টের একইধারার ই-কমার্স ব্যবসায়িক মডেল অনুসরণ করার বিষয়টিই সামনে এল।
তবে গ্রাহকরা সম্প্রতি সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি পান।
৮ নভেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি কার্যক্রম শুরু করার পর ব্যাংক হিসাবে দুই হাজার এক কোটি ২৮ লাখ টাকা থাকলেও সেখান থেকে এক হাজার ৯৯৯ কোটি ২০ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানটির জব্দ করা হিসাবে বর্তমানে মাত্র দুই কোটি ৭ লাখ টাকা আছে।
বৃহস্পতিবার মঞ্জুরুল আলম সিকদার দাবি করেন, আলেশা মার্টের কাছে মাত্র সাত হাজার গ্রাহকের পাওনা রয়েছে। পাওনার পরিমাণ কম এমন গ্রাহকদের প্রাধান্যের ভিত্তিতে অর্থ পরিশোধের প্রক্রিয়া চলছে।এর আগে নীতিগত পরিবর্তনের কারণে প্রতিষ্ঠানের অর্থ পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকা পড়েছে বলে তিনি দাবি করেন। তবে কী পরিমাণ অর্থ আটকে আছে তার উল্লেখ করেননি।
বেশ কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জানতে পারে, ব্যাংক হিসাব চালু হওয়ার পাশাপাশি গেটওয়ে পেমেন্ট ব্যবস্থায় মার্চেন্ট ফান্ড সচল হলে আলেশা টাকা ফেরত দিবে বলে তারা বিশ্বাস করেছিলেন।
এরপরও ঘাটতি থাকলে প্ল্যাটফর্মের প্রতিষ্ঠাতার অন্যান্য সম্পদ থেকে পাওনা অর্থ ফেরত পাওয়ার আশা করেছিলেন গ্রাহকরা।
আলেশার কাছে যতো দেনা
আলেশা মার্টের বিষয়ে জানতে দেশের ই-কমার্স খাতের নিয়ন্ত্রক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল টিবিএস। ফার্মটির দায়-দেনা সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই মন্ত্রণালয়ের কাছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও সেন্ট্রাল ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান এএইচএম শফিকুজ্জামান বলেন, আলেশা মার্ট নিরাপত্তা হুমকির কারণে অফিস বন্ধ করেছে এমনটাই বিশ্বাস করেছিলেন তিনি। কোম্পানিটির মালিকদের যথেষ্ট পরিমাণ সম্পত্তি থাকায় কোম্পানিটি গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ করে দেবে ভেবেছিলেন।
আলেশা মার্ট মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, কিছু গ্রাহক অতিরিক্ত সুবিধা চেয়ে কোম্পানিটির অফিসে এসে উত্তেজিত হয়ে বেপরোয়া আচরণ করে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন কোম্পানিটি আবেদন করলে তাদের অদিসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হবে।
কোম্পানিটির কিছু গ্রাহক ও বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলেছিল টিবিএস। তারা জানান, আলেশা মার্টের কাছ থেকে গ্রাহকরা নিশ্চিতভাবেই কয়েক হাজার কোটি টাকা পায়।
প্লাটফর্মটি সর্বশেষ ক্যাম্পেইনের ৪৫ হাজার মোটরসাইকেলের অর্ডার আসার ডেলিভারি লিস্ট প্রকাশ করে। গত জুন মাসে ক্যাম্পেইনটি শেষ হয়। তারা বলেন, এর অর্ধেকের বেশি পণ্যই এখনো ডেলিভারি করা হয়নি। এসব পণ্যের আনুমানিক মূল্য কয়েকশো কোটি টাকা।
ডিসকাউন্ট পেতে মোটরসাইকেল ছাড়াও স্মার্টফোন, হোম এপ্লায়েন্স ও বেশ কিছু জনপ্রিয় পণ্যের দাম আগেই পরিশোধ করেন ক্রেতারা।
একই পরিণতির পুনরাবৃত্তি?
দেশে ই-কমার্সের আড়ালে পঞ্জি স্কিমের পথিকৃৎ বলা যায় ই-ভ্যালিকে। কয়েকশো কোটি টাকা দেনা, গ্রাহকদের মামলা ও শেষ পর্যন্ত মালিকদের গ্রেপ্তার- এভাবে ভেঙে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি।
বিরাট পরিমাণ দেনা ছাড়াও অর্থ পাচারের পর একই অবস্থা হয়েছে ধামাকা শপিংয়েরও। কোম্পানিটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হয়েছে, দেশ ছেড়ে পালিয়েছে ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
ডিসকাউন্টের দিক থেকে অন্যান্য সমস্ত প্ল্যাটফর্মকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল ইওরেঞ্জ। গ্রাহকদের কাছে কয়েকশ কোটি টাকা দায় আছে কোম্পানিটির, প্রতিষ্ঠাতারাও জেলে। কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার ভাই পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানা দেশ ছেড়ে পালানোর সময় ভারতে গ্রেপ্তার হন। তিনিই এ স্কিমের মূল পরিকল্পনাকারী বলে ধারণা করা হচ্ছে।
একজন গ্রাহক আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পর কিউকমের প্রতিষ্ঠাতা রিপন মিয়া ও কোম্পানিটির মার্কেটিং প্রধান এখন জেলে।
রিপন মিয়া দাবি করছিলেন, পেমেন্ট গেটওয়ে ফোস্টারপে-তে তার যতো টাকা আটকে আছে সে তুলনায় তার দেনা খুবই কম। ফোস্টারের প্যারেন্ট কোম্পানি এসএসডি টেকের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের তদন্তের কারণে বিএফআইইউ ফোস্টারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেয়।
এ বছর হঠাত করেই সামনে আসে আনন্দ বাজার, দালাল প্লাস, বুমবুম, পারপ্লেক্স বিডি, শপেটিকসহ এক ডজনেরও বেশি একই রকম প্ল্যাটফর্ম। গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নিয়ে দীর্ঘ সময় পর পণ্য ডেলিভারির প্রতিশ্রুতি দিত কোম্পানিগুলো। ইভ্যালি এবং অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মতোই দশা হয় এসব কোম্পানিরও। গ্রাহকদের শূন্য করে বন্ধ হয়ে যায় সব কার্যক্রম।
জাতীয় ই-কমার্স নীতিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসার পর এ বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর মধ্যে ভেঙে পড়ে কোম্পানিগুলো।
যে কোম্পানিগুলো ডিসকাউন্ট-প্রেমী জনসাধারণকে ফাঁদে ফেলত, যার মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান এমনকি ডিসকাউন্ট হান্টিংকেই আয়ের উৎস বানিয়ে নিয়েছিল, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় হঠাৎ ই-কমার্স খাতের জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ে কোম্পানিগুলো। মন্ত্রণালয়ের এই নিয়মানুযায়ী, ১০ দিনের বেশি ডেলিভারির ক্ষেত্রে অগ্রিম অর্থ সংগ্রহের সুযোগ হারায় প্ল্যাটফর্মগুলো।
নতুন অর্ডারের ওপর ভিত্তি করেই যে প্ল্যাটফর্মগুলো টিকে ছিল, এ নিয়ম চালু হওয়ার পর ২৫-৫০ শতাংশ ছাড়ে ৩০-৯০ দিনে ডেলিভারি দেওয়ার সুযোগ হারায় কোম্পানিগুলো। এর সাথে সাথেই ধসে পড়তে থাকে এসব কোম্পানি।
এ বছরের জুনের শেষে ই-কমার্স অর্ডারে ইলেকট্রনিক পেমেন্টে এসক্রো সিস্টেম চালু করা হয়েছিল। বাণিজ্যকে ব্যাহত করেছিল এ পদ্ধতির কারণে কোম্পানিগুলো আগের অর্ডারের বিল পরিশোধ করতে অগ্রিম পেমেন্ট ব্যবহার করতে না পারার কারণেও তাদের ব্যবসায় ভাটা পরে।
সমস্ত পতিত অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্মের কর্মকর্তাদের মতো, আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান তার গ্রাহকদের বলতে থাকেন যে তিনি তাদের সব ফেরত দেবেন। তবে শীঘ্রই যে কোনও সময় ঘটার সম্ভাবনা কম।
অন্যান্য সব অনলাইন শপিং প্লাটফর্মের কর্মকর্তাদের মতো আলেশা মার্টের চেয়ারম্যানও তার গ্রাহকদের বলে যাচ্ছেন, তিনি সবার পাওনা পরিশোধ করবেন। তবে খুব শীঘ্রই এমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।