আবারও বিশ্বমানের ইঞ্জিন ফিল্টার রপ্তানি করতে চায় বগুড়া মটরস
বগুড়ায় তৈরি ইঞ্জিন ফিল্টার ২৯ বছর ধরে আধিপত্র নিয়ে দেশব্যাপী সুনামের সাথে ব্যবসা করে আসছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এই কারখানার ফিল্টার আন্তর্জাতিক বাজারেও নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে একাধিকবার। মানসম্পন্ন ফিল্টারের কারণে দেশের বাজারেও ক্রমাগত চাহিদা বেড়ে গেছে। দেশে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সরে আসতে হয়েছে।
তবে, সুখবর হচ্ছে এখন এই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতা এরই মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে বগুড়া মটরসে উৎপাদিত ফিল্টার ফের লন্ডন কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশে রপ্তানির পরিকল্পনা করছে।
বগুড়া মটরস সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬৫ সালে প্রায় ২ বিঘা জমি পায় বগুড়ার বিসিক শিল্প নগরী (বিসিক) এলাকায়। এই জমিতে প্রথমে পুরাতন মোটরগাড়ি মেরামত করা হতো। মূলত ইঞ্জিনের ক্র্যাঙ্ক স্যাপের কাজ বেশি করা হয়। সর্বোচ্চ ভালো সার্ভিস দেওয়ার জন্য ক্র্যাঙ্ক স্যাপের ইঞ্জিনগুলো জার্মানি থেকে আনা হয়েছিল।
কোরিয়ান যন্ত্রপাতি দিয়ে শুরু। কিন্তু এর মধ্যেই চীন থেকে ক্র্যাঙ্ক স্যাপের যন্ত্রপাতি কম দামে আমদানি হওয়া শুরু হলো। তখন বগুড়া মটরসের চাহিদা কমতে থাকে। এরপর পথ পরিবর্তন করে, ব্যবসার ধরন পাল্টে ফিল্টার তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হয় ১৯৮৯ সালে।
ফিল্টারের গুণগতমান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেওয়ার চেষ্টা প্রথম থেকেই করা হয়। তবু চার বছর লেগেছে এই ফিল্টার দেশের মানুষকে চেনাতে। বিশ্ব চিনেছে ২০০৭ সালে।
২০০৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্য আন্তর্জাতিক মান সংস্থা (আইএসও) থেকে সনদ পায়। আর ২০০৭ সালে ছয় থেকে সাতবার কানাডায় বগুড়া মটসের ফিল্টার রপ্তানি করা হয়। কিন্তু তখনই দেশে চাহিদা বেড়ে যায়। একই সাথে বিদেশে রপ্তানি করে তেমন লাভ হয় না। এ কারণে রপ্তানির বিষয়টি বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্থানীয় পর্যায়ে প্রায় পৌনে ২০০ শ্রমিক নিয়ে করোনার মধ্যেও পুরোদমে উৎপাদন বজায় রেখেছে উত্তরবঙ্গের স্বনামধন্য এই প্রতিষ্ঠান।
এই প্রতিষ্ঠানে সব মিলিয়ে প্রায় ৪০০ রকমের ফিল্টার তৈরি করা হয়। মোটরসাইকেল থেকে শুরু করে কমপ্রেসার ইঞ্জিনের বড় ফিল্টার এখানে তৈরি করা হয়। সবচেয়ে ছোট ফিল্টার মোটরসাইকেলের। এর দাম ৬০ টাকা থেকে শুরু। আর বড় ফিল্টারের দাম ২ হাজার থেকে ২০ হাজার থেকে টাকা পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি চাহিদা মোটরসাইকেল, বাস, ট্রাক, কার ও মাইক্রোবাসের ফিল্টারের। এই ফিল্টারগুলো ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকা করে বাজারে বিক্রি করা হয়।
কাঁচামালও বিশ্বমানের
ফিল্টার তৈরি করতে সবচেয়ে বেশি লাগে ফিল্টার পেপার। ফিল্টার পেপার বিভিন্ন কোয়ালিটির হয়ে থাকে। এখন এসব পেপার কোরিয়া থেকে আমদানি করা হয়। তবে আগে আদমানি করা হতো জার্মানি থেকে। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সরাসরি আমদানি করে বগুড়া মটরস। ফিল্টারের সঙ্গে আঠা লাগে উচ্চ মানের। এই আঠাও বেশিরভাগ আমদানি করা হয় উত্তর কোরিয়া থেকে। তবে থাইল্যান্ডের আঠাও খুব ভালো। এর বাইরে, ভারত থেকে দুবার আঠা আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু গুণগত মান খারাপের কারণে পরে সেখান থেকে আর নেওয়া হয়নি।
ফিল্টার ভালো করতে কেসিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই কেসিং উত্তর কোরিয়া থেকে আমদানি করা হয়। প্লেন শিট লাগে অনেক বেশি পরিমাণ। এই পণ্য আমদানি করা হয় না। তবে জাপান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠান আমদানি করে। সেখান থেকে বগুড়া মটরস কিনে নেয়। রাবার ও প্লাস্টিকের দানা দেশীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ক্রয় করা হয়। কেসিংয়ের রং এই প্রতিষ্ঠানে করা হয়।
দেশের বাজারে জয়জয়কার
উৎপাদনে যাওয়ার ঠিক চার বছরের মাথায় বাজার পাওয়া যায়। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। তবে বগুড়ায়ও অনেক বেশি চলে। দেশে তৈরি ফিল্টার এককভাবে বগুড়া মটরসের চেয়ে বেশি কোনো কোম্পানির চলে না বলে জানিয়েছেন বিসিকের একাধিক উর্দ্ধতন কর্মকর্তা। এই প্রতিষ্ঠানের উৎপদনের সক্ষমতা রয়েছে ২ লাখ পিস। তবে এখন উৎপাদন করা হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার পিস। অবশ্য ছোট বড় ফিল্টারের উপর নির্ভর করে। ছোট ফিল্টার উৎপাদন বেশি পরিমাণ করা হয়। অন্তত ২০০ জন শ্রমিক রয়েছে এই কর্মযজ্ঞে।
দুই বন্ধুর হাত ধরে শুরু
বগুড়া জিলা স্কুলে পড়াশোনার সময় আমিনুল ইসলাম ও আহমেদ রেজাউর রহমানের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। পড়াশোনা শেষে দুজনে মিলেই শুরু করেন ঠিকাদারি। এক পর্যায়ে তারা প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার হয়ে ওঠেন। এরপর দুজন বন্ধু মিলে প্রথমে গাড়ি মেরামতের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এরপর শুরু করেন মোটর পার্টস এর দোকান।
এরপর ১৯৭৭ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। ১৯৮৯ সালে ইঞ্জিন ফিল্টার তৈরির যাত্রা শুরু। প্রথমে বাজার পেতে বেগ পেতে হয়। এক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিকমানের ফিল্টার তৈরি শুরু করে।
এখন বগুড়া মটরসের পরিচালক পাঁচজন। তারা হলেন আমিনুল ইসলামের দুই ছেলে ডা. তাহমিদুল ইসলাম ও সিরাজুল ইসলাম। আর আমিনুলের স্ত্রী জেবুন্নেছা ইসলাম। অন্য আরও দুজন পরিচালক হলেন আহম্মেদ রেজাউর রহমান ও তার একমাত্র ছেলে সিব্বির আহম্মেদ।
বগুড়া মটরসের প্রডাকশন ম্যানেজার (স্পেশাল ফিল্টার সেকশন) মো. মাহবুব মোর্শেদ সিদ্দিক প্রায় এক যুগ ধরে কর্মরত রয়েছে এখানে। এই কর্মকর্তা বলেন, 'এই ফিল্টারগুলো সাধারণত ইঞ্জিনের কাজে লাগে। বিভিন্ন ধরনের গাড়ির ফিল্টার, জেনারেটরের ফিল্টার, কিছু কৃষি যন্ত্রপাতির ফিল্টার তৈরি করা হয়। যেখানে ইঞ্জিন ও তেলের কাজ আছে সেখানে এই ফিল্টার কাজে লাগে। এগুলোর মানও বিশ্ব মানের।'
বগুড়া মটরসের ব্যবস্থাপক মো.নুরুল ইসলাম বলেন, 'কানাডাতে অবস্থান করা এক বাংলাদেশি প্রথম এই ফিল্টার কানাডাতে রপ্তানি করেন। পরে তিনি আমাদের কাছে আরও চাহিদাপত্র দেন। কিন্তু তখন দেশের বাজারের এতো চাহিদা ছিল যে আন্তর্জাতিক বাজারে আর ফিল্টার দেওয়া সম্ভব হয়নি। আরব আমিরাত থেকে বগুড়া মটরসের ফিল্টারের একটি চাহিদাপত্র দেওয়া হয়। একই কারণে সেখানে দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে এখন আমরা নতুন উদ্যোমে ফিল্টার রপ্তানির কথা ভাবছি। আশা করছি বিশ্বের বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের পণ্য জায়গা করে নিবে।'
'দেশের মানুষের সাথে প্রতারণার আশ্রয় বগুড়া মটরস নেয় না। এই কারণে এখানে উৎপাদিত প্রতিটি ফিল্টারের গায়ে মেড ইন বাংলাদেশ লেখা থাকে' বলে জানালেন বগুড়া মটরসের পরিচালক ডা. তাহমিদুল ইসলাম চন্দন। তিনি বলেন, "আমাদের প্রতিষ্ঠানের ফিল্টারের গায়ে মেড অ্যাজ জাপানও লেখা হয় না। কিন্তু সমস্যা হলো, যারা বিভিন্ন প্রাইভেট গাড়ির মালিক তারা দোকানে গিয়ে বিদেশি পণ্য চান। কিন্তু বিদেশি মোড়কের এসব পণ্যের সমস্যা রয়েছে। দেশের বিভিন্ন আন্ডারওয়ার্ল্ডে কিছু প্রতিষ্ঠান ফিল্টার তৈরি করে পণ্যের মোড়ক লাগান 'মেড ইন জাপান'। এভাবে প্রতারণা করা হচ্ছে। এই বিষয়গুলো সরকারের কর্মকর্তাদের খোঁজ খবর নেওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, আমরা জাপানি সব গাড়ির ফিল্টার তৈরি করি। এ কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাদের ফিল্টার নেপাল, ভুটান, কানাডা কিংবা লন্ডনে রপ্তানি করার। কিন্তু ভারতের বর্ডারে কিছু সমস্যা রয়েছে। বিমানে এই পণ্য নিয়ে গিয়ে খুব বেশি ভালো করা সম্ভব হবে না। খরচ বেশি। ভারতের সাথে ঝামেলা মিটাতে পারলে নেপাল-ভুটানে ব্যাপক বাজার ধরা যাবে। তবে এখন প্রতিযোগিতার বাজার উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে, যেমন, আমাদের কাঁচামাল রপ্তানি করতে সরকারকে ব্যাপক পরিমাণ ট্যাক্স দিতে হয়। আমদানিতে খরচ বেশি হয় এতে। ফলে উৎপাদন খরচও বেশি পড়ে। এই বিষয়টি সরকারের বিবেচনা করা দরকার। ট্যাক্স কমালে আমরা পণ্য রপ্তানি করে সরকারকে বেশি রাজস্ব দিতে পারব।"
তাহমিদুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের পার্টনার সিব্বির লন্ডনে রয়েছেন। ওখানে আমরা ইমপোর্টার খুঁজছি। আমরা লন্ডনেও ফিল্টার রপ্তানির চেষ্টায় আছি।'
বিশ্বে এই পণ্যের চাহিদা ব্যাপক রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের উপ-মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমানও। বগুড়ায় কর্মরত এই কর্মকর্তা বলেন, এখানে উৎপাদিত ফিল্টার আন্তর্জাতিক মানের; এটা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। আইএসও সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের পণ্যের চাহিদা দেশের সর্বস্তরে রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও তাদের তৈরি ফিল্টার নিয়েছে। এমন প্রতিষ্ঠার আর বিস্তরভাবে বিকশিত হওয়া দরকার। বগুড়ায় নতুন শিল্প নগরী গড়ে উঠবে। সেখানে এই প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় বেশি জায়গায় দেওয়া হবে।