অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না কর আহরণ
অর্থনীতির আকার, জিডিপির প্রবৃদ্ধি- সব দিক থেকেই বহু পেঁছনে থাকা নেপালের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) হার কিংবা করপোরেট ট্যাক্স রেট- সবই বাংলাদেশের চেয়ে কম। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটির কর-জিডিপির অনুপাত বাংলাদেশের তিন গুণেরও বেশি।
গত এক দশকে নেপালের জিডিপির আকার তিন গুণ বাড়লেও দেশটির ট্যাক্স রেভিনিউ বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। একই সময়ে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ও ট্যাক্স রেভিনিউ উভয়ই বেড়েছে প্রায় সমান সাড়ে তিন গুণ। জিডিপির আকারের প্রায় দ্বিগুণ হারে নেপালের ট্যাক্স রেভিনিউ বাড়লেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা সমান্তরাল রয়ে গেছে।
২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে নেপালের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ১৪.৭৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৫.২৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। একই সময়ে বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত ৯ শতাংশ থেকে কমে ৭.৫৯ শতাংশে নেমেছে।
শুধু নেপালই নয়, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের মতো উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মঙ্গোলিয়া, তাজাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ১৮ থেকে ২৪ শতাংশের মধ্যে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলো, বিশেষ করে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের তালিকায় থাকা দেশগুলোর রেভিনিউ গ্রোথ প্রায় ২৫ শতাংশের মতো। আর বাংলাদেশে গত এক দশকে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে গড়ে ১৪ শতাংশ হারে।
তারা আরও বলছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাজারমূল্যে জিডিপির প্রবৃদ্ধির চেয়ে করের হারে সাধারণত দেড় গুণ প্রবৃদ্ধি হয়ে থাকে। আর বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির চেয়ে কর আহরণ হার উল্টো কমেছে।
এশিয়ান দেশগুলোর ট্যাক্স-টু-জিডিপির একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ পর্যবেক্ষণ করেছে আইএমএফ [২০১৮]। তাতে দেখা গেছে, ট্যাক্স-টু-জিডিপির আনুপাতিক হার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। ট্যাক্স-টু-জিডিপির অনুপাত ১৫ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার ব্যাপারে এশিয়ান দেশগুলোকে পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের ট্যাক্স-টু-জিডিপির অনুপাত মাত্র ৭.৫৯ শতাংশ, যা আইএমএফ-এর পরামর্শের অর্ধেক।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির আকার যে হারে বাড়ছে, ট্যাক্স রেভিনিউ সে হারে বাড়ছে না। তাদের মতে, কর প্রশাসনের অদক্ষতা, কর ছাড়, অটোমেশনের অভাব ও দুর্নীতির কারণে একদিকে প্রত্যাশিত হারে কর আদায় হচ্ছে না, অন্যদিকে কয়েক বছর ধরে জিডিপির আকারও কিছুটা বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে। এর ফলে কর জিডিপি অনুপাত কমছে।
দেশের জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং কর-জিডিপি অনুপাতের নিম্নমুখী প্রবণতার কারণ বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০১৫ সালের পর থেকে জিডিপির যে প্রবৃদ্ধির তথ্য সরকার দিচ্ছে, তার সঙ্গে একমাত্র রেমিটেন্স ছাড়া অন্য কোনো সূচকের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। পাঁচ বছর আগেও জিডিপির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে অন্যান্য সূচকের এত বেশি গড়মিল দেখা যায়নি।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি টার্গেট করা হয়েছিল, প্রতি বছরই তার খুবই কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু আগের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলোর টার্গেটের সঙ্গে প্রবৃদ্ধির হারে বড় ধরনের ফারাক দেখা যেত। গত পাঁচ বছর ধরে টার্গেট ও অর্জন কীভাবে এতটা মিলে যাচ্ছে, তা নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, একাউন্টিং স্ট্যাটিসটিক্স হিসাবে ট্যাক্সের তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। আর ইসটিমেটিং স্ট্যাটিসটিক্স হিসেবে জিডিপির তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই কম। ইসটিমেশনের ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব করায় এর তথ্যে অনেক ফাঁক-ফোকর থাকতে পারে।
গত এক দশকের জিডিপি এবং ট্যাক্স রেভিনিউয়ের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল ৮ লাখ কোটি টাকা, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭.৪ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এক দশকে গড়ে প্রতি বছর টাকার অংকে ১৩.৪ শতাংশ হারে জিডিপি বেড়ে অর্থনীতির আকার দাঁড়িয়েছে ৩.৫ গুণ।
অন্যদিকে, এক দশক আগে বাংলাদেশের ট্যাক্স রেভিনিউর পরিমাণ ছিল প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২.১৯ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ, এক দশকে ট্যাক্স রেভিনিউর পরিমাণও বেড়ে ৩.৫ গুণ হয়েছে।
গত এক দশকে বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপির গড় অনুপাত ৯.৪ শতাংশ। এই সময়ে কর আহরণ বেড়েছে ১৪ শতাংশ হারে।
অর্থমন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০১১-১২ অর্থবছরে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ১০.৪ শতাংশ ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত অর্জন করে। তারপর তিন বছর ধারাবাহিকভাবে এটি কমার পর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০.৩ শতাংশ।
এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে আবারও কমতে শুরু করেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছর দেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ছিল ৭.৫৯ শতাংশ। অথচ এই এক দশকে কম্বোডিয়ার ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ প্রসঙ্গে জানান, বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। কারণ, সরকার বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে কর ছাড় দিয়ে থাকে। এসব প্রকল্পে কর ছাড় দেওয়া না হলে ট্যাক্স-রেভিনিউ রেশিও আরও বেশি হতো, কিন্তু প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যেত, যা চূড়ান্তভাবে জনগণের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করত।
বাংলাদেশের জিডিপি গ্রোথ ও ট্যাক্স গ্রোথ বিশ্লেষণ করে এক বিস্ময়কর তথ্য মেলে। তা হলো, নির্বাচনী বছর ও রাজনৈতিক সহিংসতার বছরগুলোতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার আগের বছরের তুলনায় বেশি হলেও ট্যাক্স রেভিনিউ প্রবৃদ্ধির হার আগের বছরের তুলনায় কম হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ঘিরে বছরব্যাপী রাজনৈতিক সহিংসতা সত্ত্বেও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছিল। কিন্তু আগের বছরের তুলনায় ওই বছর ট্যাক্স রেভিনিউ গ্রোথ প্রায় ৫ শতাংশ পয়েন্ট কমে যায়।
একইভাবে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন ঘিরে খুব বেশি সহিংসতা না হলেও ওই বছরও আগের অর্থবছরের তুলনায় রেভিনিউ প্রবৃদ্ধি কমে যায় প্রায় ৯ শতাংশ পয়েন্ট। কিন্তু ওই অর্থবছরও আগের বছরের তুলনায় জিডিপিতে বাড়তি প্রবৃদ্ধি পায় বাংলাদেশ।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, ট্যাক্স রেট অপরিবর্তিত থাকলে অর্থনীতির আকার বাড়লে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত কমার কথা নয়, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে। যদিও বাংলাদেশের সমমানের অন্যান্য দেশে গত এক দশকে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
'অর্থনীতির আকার বাড়লে নতুন নতুন খাত সৃষ্টি হয়, তাই কর হার না বাড়লেও সেসব খাত থেকে বাড়তি কর আদায় হওয়ায় বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিগুলোতে ট্যাক্স বায়েন্সি ১.৪-১.৫-এর মধ্যে থাকে। কিন্তু আমাদের জিডিপির হিসাব ওভাররেটেড করা ছাড়াও সামগ্রিকভাবে সরকার ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার অবনতি ও হিউম্যান ক্যাপিটাল রিসোর্সের অবনতি হয়েছে,' জানান তিনি।
তিনি বলেন, সময়ের সঙ্গে এনবিআরের পরিবর্তন ঘটেনি। কর ও ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, ফাইলিং, অডিটিংয়ে উন্নতি হয়নি, যদিও এজন্য বেশকিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছুটা অগ্রগতি থাকলেও তা ইতিবাচক ফলাফল দেওয়ার মতো যথেষ্ট নয়।
সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তওফিকুল ইসলাম খান বলেন, একাউন্টিং স্ট্যাটিসটিক্স হিসাবে ট্যাক্সের তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। আর ইসটিমেটিং স্ট্যাটিসটিকস হিসেবে জিডিপির তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই কম। ইসটিমেশনের ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব করায় এর তথ্যে অনেক ফাঁক ফোকর থাকতে পারে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে তুলনীয় সাউথইস্ট এশিয়া সমপর্যায়ের দেশ ও এলডিসির তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা দেশগুলোর কর আহরণ প্রতিবছর ২৪ শতাংশের মতো বাড়ছে, যা বাংলাদেশে অনেক কম। এ হিসাবে সহজেই বলে দেয়া যায়, কর আহরণে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে।
তিনি বলেন, কর প্রশাসনের দক্ষতায় ঘাটতি থাকার কারণে কর ফাঁকি ও কর পরিহারের প্রবণতা বাড়ছে। কর কাঠামোর পুনর্গঠন নিয়ে বড় ধরনের আলোচনা হলেও তা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি।
তওফিকুল ইসলাম আরও বলেন, 'আমাদের ট্যাক্স পলিসি খুব বেশি এডহক আর আরবিট্ররি। নীতিমালা পাশ কাটিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে অনেক খাত, প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যাক্তিকেও কর ছাড় দেওয়া হয়। কর ছাড়ের কারণে রাজস্ব আহরণে বা অর্থনীতির অন্যান্য খাতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে এমন আলোচনাও করা হয় না।'
তিনি বলেন, এসব কারণে ইকোনমির বড় একটা অংশ দীর্ঘমেয়দে কর ছাড় বা রেয়াতি কর সুবিধা পাচ্ছে। যেমন তৈরি পোশাক অনেক বছর ধরেই নামমাত্র কর দিচ্ছে। আকার বাড়লেও কৃষি খাত ও মাছ চাষ করের আওতার বাইরে আছে।