অর্থঋণ আদালতে আটকে আছে ১০,৬৩২ কোটি টাকা
চলতি বছরের জুনের শেষ দিকে অর্থঋণ আদালতে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ১৭ হাজার ৪৩২টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলার বিপরীতে আটকে আছে ১০ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা। যা প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমানে থাকা মোট খেলাপির চেয়েও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।
আদালতে আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ এখন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণের চেয়ে বেশি বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
বর্তমানে দেশে ৩৪টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৬৭ হাজার ১১৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১০ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অর্থঋণ আদালতে অনেক মামলা হাই কোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে। এছাড়া চাহিদার তুলনায় দেশে অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা কম। আদালতগুলোর বিচারকসংখ্যাও যথেষ্ট নয়। নানা কারণে অর্থঋণ আদালতের মামলাজট তৈরি হচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর হয়রানিও বাড়ছে। মামলা ঝুলে থাকায় গ্রাহকরাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মমিনুল ইসলাম বলেন, 'ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা এসব মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ান। আদালত থেকে বারবার স্টে অর্ডার বা স্থগিতাদেশ নিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করতে দেন না। ফলে শুধু বছর নয়, যুগের পর যুগ ঝুলে থাকে এসব মামলা।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আদালতে দায়ের করা মামলার সংখ্যা ২৮ হাজার ২০৭টি। এসব মামলার বিপরীতে অর্থের পরিমাণ ১২ হাজার ৮৯০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০ হাজার ৭৭৫ টি মামলা, যেখানে অর্থের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২৫৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের জন্য পুনঃতফসিল পুনর্গঠন, এককালীন পরিশোধসহ গত এক দশকে ঋণখেলাপিদের জন্য একাধিক বিশেষ সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এসব সুবিধা পেয়েও ঋণ পরিশোধ করছে না খেলাপিরা। ক্রমাগত বেড়েছে খেলাপি ঋণ।
অন্যদিকে দু-একটি ছোটখাটো ঘটনা ছাড়া ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ তেমন চোখে পড়ে না।
এমন পরিস্থিতিতে মামলাজট কমাতে বিশেষ আদালত চালু করার পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব-উল-আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'হাই কোর্টের আদেশের মাধ্যমে অর্থঋণ আদালতের মামলা বছরের পর বছর আটকে আছে। এছাড়া চলমান মামলার বিচারকাজ অযৌক্তিকভাবে মুলতবি রাখা হয়। বিচারকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হচ্ছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'হাই কোর্টের আদেশে যে মামলাগুলো স্থগিত রয়েছে, সেগুলো বাতিলের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এজন্য উদ্যোগ নিতে হবে। স্থগিত মামলাগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির কাছে দিতে হবে। আইন মন্ত্রণালয় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলাপ করে এসব স্থগিতোদেশের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।'
এছাড়াও অর্থঋণের আদালত ও বিচারক বৃদ্ধি এবং দক্ষ বিচারক দিয়ে এসব মামলার বিচার পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে বলে মন্তব্য করেন ব্যারিস্টার তানজীব-উল-আলম।