অপ্রতুল কৃষি বাজেট: আশু ঘুরে দাঁড়ানোর আশা ম্লান
করোনাভাইরাস সংকটকালে কৃষিকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত বিবেচনা করলেও বাজেট প্রতিশ্রুতির অনেক কিছুই এখনো এ খাতে অধরা।
সরকারি তথ্য ও মাঠ পর্যায়ে পর্যালোচনায় দেখা যায়, কৃষি ও খামারকে যান্ত্রিকীকরণে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প নেওয়া হলেও তা এখনো সূচনা পর্বে। কাজ শুরু হয়নি কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে গ্রোথ সেন্টার নির্মাণের ঘোষণার বাস্তবায়ন। এডিপিতে বড় বরাদ্দ রাখলেও অর্থবছরের নয় মাসে ৮২টি প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৪৯.১০ শতাংশ অর্থ।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বরাদ্দ যথার্থ না পাওয়া, করোনার কারণে মাঠ পর্যায়ে ঠিকমতো মুভমেন্ট না হওয়া এবং যথাযথ উদ্যোগের অভাবে অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ করা যায়নি। করোনার প্রকোপ দ্বিতীয় দফায় বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে না আসা এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন তারা।
তবে কৃষকদের জন্য রিফাইন্যান্সিং খাতের ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের সফলতা আশা জোগাচ্ছে তাদের।
করোনাকালীন অর্থনৈতিক রিকভারির জন্য কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাজেট প্রণয়নের প্রস্তাব করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারও স্বাস্থ্যের বাইরে কৃষিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে চলতি অর্থবছরের বাজেটে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, 'কৃষি হচ্ছে আমাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত। আমরা অধিক খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ ও বীজে প্রণোদনা, কৃষি পুর্নবাসনে জোর প্রদান এবং সারের ওপর ভর্তুকি প্রদান করব।'
অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রমতে, চলতি বাজেটে কৃষি খাতের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে ৯ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছে। কৃষি খামার যান্ত্রিকীকরণে নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প। বাজারে চালের ন্যায্য দাম ও স্থিতিশীল রাখতে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ টন বাড়ানো হয়েছিল। কৃষকদের ঋণ প্রাপ্তি সহজ করার লক্ষ্যে কৃষি রিফাইন্যান্সি স্কিম গঠন করে ৫ হাজার কোটি টাকা এবং নিম্ম আয়ের কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য ৩ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম ঘোষণা ছিল বাজেট বক্তৃতায়।
কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট উৎপাদন ও সেবা, ক্ষুদ্র ব্যবসা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতে গ্রামের দরিদ্র কৃষক ও বিদেশ ফেরত প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক এবং পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ৫০০ কোটি করে মোট ২০০০ কোটি টাকা বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠা খাতে এডিপির মোট বরাদ্দের ২২ শতাংশ, অর্থাৎ ২২ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়া কৃষি ও অকৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সারা দেশে ১৯৫টি গ্রোথ সেন্টার গঠনের উদ্যোগ ছিল।
এর মধ্যে ঋণের ৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এপ্রিল পর্যন্ত বিতরণ প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এটি ছাড়া বাকি সব প্রকল্পেই বেশ পিছিয়ে কৃষি খাত।
এডিপি বরাদ্দের মাত্র ৪৯ শতাংশ ব্যবহার
চলতি অর্থবছর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত হিসাবে খাতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থার বাস্তবায়নাধীন ৮২টি প্রকল্পের জন্য ২২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করে সরকার। মার্চ পর্যন্ত প্রথম নয় মাসে বরাদ্দের মাত্র ৪৯.১০ শতাংশ ব্যয় হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন (ডিএই)। প্রতিষ্ঠানটি মোট ২৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের মোট ৪২.৭৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছে।
ডিএই'র মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, 'ব্যয় কম হওয়ার মানে কিন্তু কাজ থেমে থাকা না। ইনফ্রাট্রাকচার ডেভেলপমেন্টের অনেক কাজ আছে। যেগুলোর বিল না হওয়া পর্যন্ত সেটা ব্যয়ের তালিকায় যোগ হয় না। কিন্তু কাজ চলমান। জুনের মধ্যে এই প্রকল্পগুলোর বরাদ্দকৃত অর্থের পুরোটাই ব্যয় হয়ে যাবে।'
কৃষি মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (বিএডিসি) ২৩টি প্রকল্পের জন্য। যদিও প্রতিষ্ঠানটি বরাদ্দকৃত অর্থের ৫৪.৭৮ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে মার্চ পর্যন্ত। তবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার অ্যাগ্রিকালচার (বিআইএনএ) তাদের প্রকল্পের বরাদ্দের বিপরীতে ব্যয় করেছে মাত্র ২২.৮৬ শতাংশ।
১১ শতাংশ কাজের লক্ষ্য কৃষি যান্ত্রিকীকরণে, তবু সংশয়
কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৩০২০ কোটি টাকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, যা মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। চলতি বছর এই প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের মধ্যে ৫৭৭৬ (জুন) টি কম্বাইন্ড হার্ভেষ্টর, রিপার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার বিতরণ করা হবে, যা মোট প্রকল্পের কৃষিযন্ত্র বিতরণের ১১.২৫ শতাংশ। এর জন্য মোট বরাদ্দ ছাড় করা হয়েছে ২০৮.৮৬ কোটি টাকা। যার পুরোটাই চলতি বছরে ব্যয় করা সম্ভব হবে বলে জানা গেছে।
২০২৫ সালের মধ্যে এই প্রকল্পের আওতায় ৫১,৩০০টি কৃষিযন্ত্র বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাসহ বিভিন্ন কারণে কৃষিযন্ত্র বিতরণ কার্যক্রম শুরু করতে বেশ খানিকটা দেরি হয়েছে। গত এপ্রিলে কৃষিযন্ত্র বিতরণ শুরু হয়েছে এবং মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ১৬৬৬টি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর, ২১টি রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ও ৪৭০টি রিপার বিতরণ করা হয়েছে, যা চলতি বছরে বিতরণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও কম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের পিডি বেনজীর আলম টিবিএসকে বলেন, 'এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা আমরা পূরণ করতে পারব। কিন্তু করোনার কারণে বিতরণ কার্যক্রম দেরি না হলে লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়ানো সম্ভব হতো।'
তবে পরের বছরগুলোতে এই বিতরণ কার্যক্রম আরও বেশি হবে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, সারা দেশে ৫০ শতাংশ ও হাওর-উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষকদেরকে এসব কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে।
স্বস্তি রিফাইন্যান্সিং ঋণ বিতরণে
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য বাজেট থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার রিফাইন্যান্সিং ঋণ বিতরণের ঘোষণা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণকৃত এ ঋণের ক্ষেত্রে তুলনামূলক সফল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৩৯৩৬ কোটি টাকা বিতরণ করেছে সরকার। এ খাতে সুবিধাভোগী কৃষকের সংখ্যাও প্রায় ২ লাখ।
অর্থবছরের বাকি দুই মাসে এ ঋণ বিতরণ সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার প্রস্তাব বিশেষজ্ঞদের
মহামারি করোনায় দেশের মানুষকে সুরক্ষা দিতে কৃষি, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট প্রণয়নের প্রস্তাব করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনুসর বলেন, অতিমারির মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে, পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তায় নিশ্চিত করতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। চলতি বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পেছনে মূল ভূমিকা কৃষি খাতের। এ খাতের বরাদ্দের পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে অর্থনীতি রিকভারির প্রধান খাত হিসাবে এটিকে গড়ে তোলার কথা ছিল। কিন্তু সরকার তা পারেনি।
'খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সার, বীজের ভর্তুকি ও প্রয়োজনীয় উপকরণের পাশাপাশি কৃষিপণ্যের নায্যমূল্য নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য কৃষক প্রতিনিধির অংশগ্রহণে জাতীয় কৃষিপণ্যের মূল্য কমিশন গঠন করতে হবে,' যোগ করেন আহসান এইচ মনসুর।
আগামী অর্থবছর কৃষি খাতের জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি।