ব্রিটেনের রাজবংশের শোকের পোশাকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

ব্রিটেনের প্রয়াত রানির রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্যানুষ্ঠানে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সম্মানে ব্রিটিশ রাজ পরিবারের সদস্যরা শোকের পোশাকের রীতি মেনে কালো রঙা পোশাক পরবেন।
রাজা তৃতীয় চার্লস আনুষ্ঠানিক পোশাক পরিধান করবেন যাতে ঝুলানো থাকবে তার মেডেলগুলো। এছাড়া, বহন করবেন লাল মখমলের কাপড় এবং ২০১২ সালে ফিল্ড মার্শাল উপাধি পাওয়ার সময়ে রানির প্রদত্ত সেই ফিল্ড মার্শাল ব্যাটন। এছাড়া, প্রিন্স এডওয়ার্ড, প্রিন্সেস অ্যানি ও প্রিন্স উইলিয়াম সকলেই সামরিক পোশাক পরিধান করবেন, পোশাকের সাথে শোভা পাবে তাদের মেডেলগুলোও।
যেহেতু প্রিন্স হ্যারি ও প্রিন্স এন্ড্রু রাজকীয় পরিবারের কোন দায়িত্বে নেই সেহেতু তারা মিলিটারি সার্ভিসের অবসরপ্রাপ্ত সদস্য হওয়া সত্ত্বেও বেসামরিক পোশাক পরিধান করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। নারীরা কালো পোষাক ও 'ফরমাল হ্যাট' পরিধান করবেন এবং পুরুষরা কালো 'মর্নিং কোট' পরিধান করবেন।
শত বছর ধরে পরিবর্তনের মাধ্যমে নির্ধারণ হওয়া এই ড্রেস কোডগুলো রাজকীয় পরিবারের সদস্যরা কীভাবে ধারণ করছেন তার দিকে নজর থাকবে এই দুঃখের সময়েও।

১৯৮২ সালে অভিনেত্রী এবং মোনাকোর প্রিন্সেস গ্রেস কেলির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় প্রিন্সেস ডায়ানাকে একটি ঘোমটাযুক্ত টুপি, কলারযুক্ত লম্বা-হাতা কালো পোশাক এবং হার্ট শেপের নেকলেস পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়।
২০২১ সালে ব্রিটিশ ফ্যাশন ইতিহাসবিদ এবং কিউরেটর কেট স্ট্রাসডিন একটি ভিডিও সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, 'জনসাধারণের প্রত্যাশার প্রতি নজর রাখা এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে সঠিক আচরণের জ্ঞান ছিল প্রিন্সেস ডায়ানার।'
১৯৯৭ সালে প্রিন্সেস অফ ওয়েলসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় তোলা– প্রিন্স ফিলিপ, প্রিন্স উইলিয়াম, ডায়ানার ভাই চার্লস স্পেন্সার, প্রিন্স হ্যারি এবং প্রিন্স চার্লসের কালো স্যুট পরে কফিনের পিছনে হাঁটার– হৃদয়বিদারক চিত্রটি সমকালীন রাজকীয় ইতিহাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছবি। এটি আধুনিক রাজকীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পোশাকের প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হয়।
যদিও ঊনিশ শতকে কালো রঙ শোকের সাথে সমার্থক হয়ে উঠেছিল, তবে মধ্য যুগে এই রঙটি বিত্তবানদের কাছে সবচেয়ে পছন্দের ছিল। স্ট্রাসডিনের মতে, ইউরোপ এবং আমেরিকায় এই সময়কালেই 'শোক পোশাকের' ধরন নির্ধারণ করা হয়েছিল।
এমনকি আধুনিক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের জন্ম হয়েছিল নবজাতকের শেষকৃত্যে প্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান থেকে। স্ট্রাসডিন বলেন, '১৮৪০ এর দশকের কাছাকাছি সময়ে লন্ডন এবং প্যারিসে যে 'বিশাল এম্পোরিয়ামগুলি' প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা শেষকৃত্যের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসের 'সিঙ্গেল স্টপ' হিসেবে কাজ করত।'
'একই ছাদের নিচে, আপনি স্টেশনারি থেকে শুরু করে শোকের গয়না পর্যন্ত সবকিছুই পেতে পারেন'।

২০১৪ সালে 'ডেথ বিকামস হার: এ সেঞ্চুরি অফ মোর্নিং অ্যাটায়ার' নামক এক প্রদর্শনী হয় মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট-এ। সেই প্রদর্শনীর ভূমিকায় বলা হয়েছে, 'একজন ব্যক্তির শোকের প্রকাশের ধরন পরিগণিত হতো 'দুঃখের দৃশ্যমান প্রতীক হিসেবে... একই সাথে পরিধানকারীর অবস্থা, স্বাদ এবং যোগ্যতার স্তর নির্দেশ করতো।'
ডি.সি. কোলসওয়ার্দি তার ১৮৬৭ সালে প্রকাশিত বই 'হিন্টস অব কমন পোলাইটনেস' এ লিখেছেন, 'যখন মহিলারা সাবেল
পরতে দেখি, তখন এক যুবতী বিধবা তার মাকে দেওয়া উত্তরের কথা মনে পড়ে। যুবতী তার মাকে বলছেন: তুমি দেখতে পাচ্ছে না, এটি আমার স্বামীর জন্য বিজ্ঞাপনের খরচ বাঁচায়।'
১৯৩৮ সালে কালো রঙ সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দুঃখের প্রতীক পরিচিতি থেকে অবসর নেয়। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের নানী কাউন্টেস অভ স্ট্র্যাথমোরের শেষকৃত্যের সময়ে ধারণ করা একটি ছবিতে দেখা যায়– এলিজাবেথের মাকে নরম্যান হার্টনেলের ডিজাইন করা একটি সাদা পোশাক পরে আছেন। পরিবারের একাধিক সদস্যের শেষকৃত্যে স্কটসের রাণী মেরিকে সাদা পোশাকে দেখা যায় যা থেকে 'সাদা শোক' ধারনাটির উদ্ভব হয়েছিল।
কিন্তু শোকের পোশাকে রানি ভিক্টোরিয়ার মতো প্রভাব আর কেউ রাখতে পারেননি। ১৮৬১ সালে তার স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্টের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পরে, রানি নিজের মৃত্যুর দিন পর্যন্ত চার দশক ধরে কালো পোশাক পরে তার দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। স্ট্রাসডিনের মতে, 'এই ভিক্টোরিয়াই দুঃখের ফ্যাশনের সূক্ষ্ম সংকেত নির্ধারণ করেছেন এবং নিজের 'চিরস্থায়ী বিধবা' পরিচয়টি বজায় রেখেছেন।'
'ভিক্টোরিয়ান যুগে, আপনি শোকের কোন পর্যায়ে আছেন তা নির্দেশ করতে পোশাকের খুব ছোট বিবরণও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে,' এভাবে স্ট্রাসডিন ব্যাখ্যা করেছিলেন।
স্ট্রাসডিনের মতে, এক বছর এবং একদিনের জন্য, বিধবারা পূর্ণ শোকের পোশাক পরবেন বলে আশা করা হত– যা উইডো'স উইড'স' নামে পরিচিত ছিল। এই পূর্ণ শোকের পোশাক গঠিত হতো কালো ক্রেপ ফ্যাব্রিকের কাপড়ের উপর কোনো অলঙ্করণ ছাড়াই। একজনের দুঃখ ম্লান হওয়ার সাথে সাথে অন্য রঙ এবং অন্যান্য কাপড়গুলি ধীরে ধীরে পুনরায় পরিধান করা যেতো। অবশেষে, আড়াই বছরব্যাপী শোকের শেষ ছয় মাসের জন্য, 'অর্ধ শোকের' পোশাক পরিধান করতো। যা সাদা, ধূসর, ফ্যাকাশে হলুদ রঙয়ের হত। কখনও কখনও তারা বেগুনি কাপড়ও পরিধান করতো– 'ডেথ বিকামস হার' প্রদর্শনীতে বেগুনি বর্ণের পোশাককেও অর্ধ শোকের পোশাক হিসেবে দেখানো হয়েছিল।

শোক শেষ হবার পর পূর্বের পোশাকে ফিরে যাওয়ার প্রথা থাকলেও রানি ভিক্টোরিয়া তার বাকি জীবন কালো পোশাকেই কাটিয়ে দেন। আলবার্টের মৃত্যুর ৩৩ বছর পরও রাণী সাদামাটা ক্রেপ গাউন পরিহিত অবস্থায় চলাফেরা করছেন— 'ডেথ বিকামস হার' প্রদর্শনীতে দেখানো এক চিত্র এটি দেখা যায়।
স্ট্রাসডিন আরও বলেছিলেন, 'ভিক্টোরিয়ার ধারাবাহিক শোকের অনুষ্ঠানটি তার প্রজাদের কাছে অপ্রিয় ছিল কারণ এটি আরও কঠোর ড্রেস কোডকে উত্সাহিত করেছিল। ভিক্টোরিয়ার পুত্রবধূ রানী আলেকজান্দ্রা, ভিক্টোরিয়ার ও তার সন্তানের মৃত্যুর পর বিধিনিষেধ শিথিল করেন।'
"তিনি জানতেন যে, 'ভিক্টোরিয়ার ক্রমাগত শোকের সাথে জনগণ সত্যিই বিরক্ত হয়ে পড়েছিল।'"
'রানি আলেকজান্দ্রা তার বাকি জীবনের জন্য অর্ধ শোক গ্রহণ করেছিলেন, কারণ তিনি জানতেন যে পূর্ণ শোকে যাওয়া সত্যিই জনসাধারণের পছন্দ ছিল না'।
কয়েক দশক ধরে, দীর্ঘ শোকের পোশাকের ঐতিহ্য অনেকটা কমে গেছে, কিন্তু ভিক্টোরিয়ার প্রভাব এখনও রাজকীয় শোকের সময়গুলোতে দেখা যায়। পোশাকের রঙ এবং ড্রেস কোডের ক্ষেত্রে তা এখনও কঠোরভাবেই মেনে চলা হয়।
সূত্র: সিএনএন