‘লর্ড অব দ্য রিংস’-এর হবিটের দেখা মিললো ইতালিতে!
ইংরেজ কবি জে আর আর টোকিয়েন এর বিখ্যাত উপন্যাস 'দ্য লর্ড অব দ্য রিংস' এবং একই নামের কালজয়ী চলচ্চিত্রটি পছন্দ করেননা এমন মানুষ খুব কমই আছেন। বাস্তবে উপন্যাসের সেই মিডল-আর্থ বা ক্ষুদে হবিটদের দেখা না পাওয়া গেলেও, ইতালির এক পেস্ট্রি প্রস্তুতকারক সত্যিকার অর্থেই হবিটদের মতো জীবনযাপন শুরু করেছেন। ইতালির মধ্যেই নিজের এক টুকরো 'শায়ার'ও আছে তার!
৩৭ বছর বয়সী নিকোলাস জেনটিলে শুধু একজন হবিটের ভান ধরে কাটাতে চাননি, বরং আক্ষরিক অর্থেই নিজের ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন। প্রথমে ইতালির আবরুজ্জো অঞ্চলের কিয়েতি শহরের কাছে অবস্থিত বুক্কিয়ানিকো শহরতলিতে এক টুকরো জমি কিনেছেন তিনি। সেখানেই নিজের স্ত্রীকে নিয়ে ব্যক্তিগত 'শায়ার' তৈরি করেছেন নিকোলাস।
গত ২৭ আগস্ট একদল বন্ধুবান্ধব এবং 'লর্ড অব দ্য রিংস' এর বামন, হবিট, জাদুকর ও মানুষের সাজে সজ্জিত ভক্তদের সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন নিকোলাস জেনটিলে। কিয়েতি থেকে নেপলসের দিকে ১২০ মাইল পথ হেঁটে পাড়ি দেন তারা। এতদূর পাহাড়-নদী পেরিয়ে আসার উদ্দেশ্য ছিল একটাই, 'আংটি' ছুড়ে ফেলা। পাঠকেরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এখানে কোন আংটির কথা বলা হচ্ছে। হ্যাঁ, লর্ড অব দ্য রিংস সাগার সেই বিখ্যাত আংটির আদলে একটি আংটিই ভিসুভিয়াস পর্বতের আগ্নেয়গিরির মুখে ফেলেছেন তারা।
নিকোলাস বলেন, "কিছুদিন আগেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, শুধু বই আর চলচ্চিত্র এইসব ফিকশন গল্প সম্পর্কে আমার প্যাশনকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। বিশেষ করে লর্ড অব দ্য রিংস সাগা'র ব্যাপারটা। কিন্তু আমি তখনো পড়ছিলাম এবং মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানছিলাম। এরপরই আমি পুরোদমে হবিটদের মতো জীবনযাপন করার সিদ্ধান্ত নেই।"
নিজের কেনা দুই হেক্টর জমিতে ইতিমধ্যেই প্রথম বাড়ির কাজ শেষ করেছেন নিকোলাস। সেখানে তিনি হবিটদের মতোই পোশাক পরে থাকেন এবং পরিবারের সঙ্গে বাস করছেন। বলে রাখা ভালো, অতিথিদের জন্যও তার দরজা সবসময় খোলা। ভূতত্ত্ববিদ্যায় ডিগ্রিধারী নিকোলাস এখন বামনদের ক্যারাভান, গ্রিন ড্রাগন সরাইখানা এবং বিলবো ব্যাগিনসে'র ঘরের একটি বৃহত্তর সংস্করণ তৈরির পরিকল্পনা করছেন। আবরুজ্জোর এই অংশটিকে একটি হবিটদের গ্রামে পরিণত করাই তার লক্ষ্য। গ্রামের মধ্যে একটি ফার্মহাউজ রাখার কথাও ভাবছেন তিনি। এখানে এসেই যেন পর্যটকদের মনে হয়, তারা বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা একটা জাদুর শহরে চলে এসেছেন। তবে নিকোলাসের ভাষায়, বুক্কিয়ানিকোর মানুষদের জীবনযাত্রার ধরনও অনেকটা সেরকমই!
"সময়ের সাথে সাথে আমি উপলব্ধি করেছি যে আমার বন্ধু, আত্মীয়স্বজন ও বুক্কিয়ানিকোর কৃষকেরা সবসময় হবিটদের মতোই বসবাস করেছে। তারা হবিটদের মতোই কাজকর্ম করে এবং প্রকৃতির সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। তাদের উদযাপনের ধরনও হবিটদের মতো। তারা উদযাপনের জন্য বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করে; এমনকি কখনো কখনো হবিটদের মতোই সাজসজ্জা করে," বলেন নিকোলাস।
বুক্কিয়ানিকোতে প্রতি বছর 'বান্দেরেসি উৎসব' অনুষ্ঠিত হয়। এটি ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন উৎসবগুলোর মধ্যে একটি, যা প্রায় ৫০০ বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে। এই উৎসবে মানুষ মধ্যযুগীয় পোশাকে নিজেদের সাজায়, গান গায়, নাচে এবং আঞ্চলিক নানা খাবার তৈরি করে।
নিকোলাসের ভাষ্যে, "ওগুলো আসলে হবিটদেরই পোশাক। আমার মনে হয়, আমি আসলে সবসময় শায়ারেই ছিলাম। শুধু এতদিন তা বুঝতে পারিনি, তাই কোনো গ্রাম তৈরি করা হয়ে ওঠেনি। আমি চাই মানুষ আমার মনের কথা বুঝতে পারুক, আমার ফ্যান্টাসি সম্পর্কে জানুক। অনেকেই আমাদের নিয়ে মজা করে। আবার কেউ কেউ ভাবে, আমি বাস্তব জগত থেকে পালিয়ে যেতে চাইছি। কিন্তু না, আমি আমার স্বপ্ন ও অ্যাডভেঞ্চারকে বাস্তবায়ন করছি শুধু। এই এক টুকরো জমি কেনার মাধ্যমে আমি আমার অপছন্দের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি। তার বদলে আমি নিজে যেমন জীবন চাই, তেমনভাবে এটাকে সাজাচ্ছি।"
নিকোলাস মনে করেন, কপিরাইট ইস্যুর কারণে তার এই 'কাউন্টি'কে 'কন্টিয়া জেনটিলে' নামে ডাকা হবে।
তিনি আরও জানান, জনসাধারণের কাছ থেকে চাঁদা তুলে এখানে টেকসই বাড়িঘর তৈরি করা হবে এবং সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করা হবে। একজন সত্যিকারের হবিটের মতো নিকোলাসও প্রকৃতিকে অত্যন্ত ভালোবাসেন এবং এর যত্ন নিতে চান। তার ভাষ্যে, ভিসুভিয়াসে আংটি ছুড়ে ফেলার ঘটনা স্রেফ একজন 'লর্ড অব দ্য রিংস' ভক্তের পাগলামি নয়; এর মাধ্যমে তিনি একটি বার্তা দিতে চান সবাইকে।
"নানা রকম দূষণের কারণে পৃথিবী এখন হুমকির মুখে। এই দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন এখন 'সরোন' এর মতোই এক বিপজ্জনক শত্রু। টোকিয়েনের মিডল আর্থের মতো আমরাও আমাদের বাসভূমিকে রক্ষা করতে চাই। সে কারণেই আমরা এতদূর হেঁটে গিয়ে আংটি ফেলেছি। আমি একজন পরিবেশবাদী, তাই অকারণে এক টুকরো লোহা ফেলে পরিবেশ নষ্ট করতে চাইনি। এর বদলে প্রতীকী অর্থে এক টুকরো শক্ত লাভা ফেলেছি এবং আংটিটা একটা ছোট্ট ছেলেকে দিয়েছি", বলেন নিকোলাস।
আংটি নিয়ে শত শত মাইল পাড়ি দেওয়ার পথে অসংখ্য মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে নিকোলাস ও তার বন্ধুদের। তাদের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়ে আনন্দিত নিকোলাস জেনটিলে বলেন, "এত এত মানুষ আমাদেরকে নিজের ঘরে ডেকে আপ্যায়ন করতে চেয়েছে। এটা জাদুকরী ব্যাপার ছাড়া আর কি?"
সূত্র- দ্য গার্ডিয়ান