১৩ বছরে মেক্সিকোর সমান বনভূমি ধ্বংস করেছে মানবজাতি
এক সময় আদিম বনরাজি আর বিশাল বৃক্ষের রাজত্ব ছিল পৃথিবীতে। নির্মল ঝর্ণার স্রোত, হাজারো প্রজাতির পাখি, স্তন্যপায়ী আর সরীসৃপে ভরে উঠেছিল এ বসুন্ধরা। কিন্তু, মানুষের আবির্ভাবের পর থেকেই বদলাতে থাকে সবকিছু। সর্বনাশা এ প্রজাতি নিজ পায়ে কুড়াল মেরেই প্রতিনিয়ত প্রকৃতি ধ্বংসের খেলায় মত্ত।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, দু'পেয়ে প্রাণিদের উৎপাতে পৃথিবীজুড়ে হারিয়ে যাচ্ছে বন্য পরিবেশ। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় তারা জানান, শুধুমাত্র গত ১৩ বছরেই উত্তর আমেরিকা মহাদেশের তৃতীয় বৃহৎ দেশ- মেক্সিকোর সমান প্রাকৃতিক ভূমিকে সম্পূর্ণ বদলে দূষিত ও পরিবর্তিত রূপ দিয়েছে- সভ্যতার দাবিদার মানবজাতি।
গবেষণা নিবন্ধের লেখক বিজ্ঞানীরা বলছেন, ১৯ লাখ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই সম্পূর্ণ বাস্তুসংস্থান হারিয়ে যাওয়ার 'গভীর পরিণামে' ভুগছে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য।
আমাদের গ্রহের কক্ষপথ প্রদক্ষণকারী কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাওয়া চিত্র পরীক্ষা করে দেখেছেন ছয়টি দেশের ১৭ জন শীর্ষ বিজ্ঞানী। সমগ্র পৃথিবীর এসব ছবি ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তোলা হয়েছিল।
স্যাটেলাইট চিত্র দেখায়, আলোচ্য সময়ের ব্যবধানে পৃথিবীর ২০ শতাংশ ভূমির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করেছি আমরা। সেই তুলনায় মাত্র ছয় শতাংশ ভূমির উপর মনুষ্যসৃষ্ট চাপ কমেছে।
এই চাপ কমা বলতে বোঝায়; শিল্পোন্নয়ন, কৃষি, আবাসন বা অন্যান্য কাজে ভূমির ব্যবহার হ্রাস। অর্থাৎ, দেখা যায় গড় ১৪ শতাংশ চাপ বেড়েছে প্রকৃতির উপর।
রাশিয়া, কানাডা, ব্রাজিল এবং অস্ট্রেলিয়ায় পৃথিবীর অমলীন জমির ৬০ শতাংশ অবস্থিত। অমলীন মানে; এসব বন্য ভূমি মানুষের হাতে পরিবর্তনের শিকার হয়নি।
এই নির্মল বন্য ভূপ্রকৃতির ১১ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা ২০০০ সালের উপগ্রহ চিত্র থেকে শনাক্ত করা যায়। কিন্তু মাত্র ১৩ বছর পর দেখা গেছে, আলোচিত বন্য জমিতে পড়েছে মানবিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপক প্রভাব।
মানুষের ক্রমঃআগ্রাসনে সবচেয়ে বেশি জমি হারিয়েছে; উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের তৃণভূমি এবং সাভানা ধরনের বনাঞ্চল। গবেষনায় পাওয়া এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে জার্নাল ওয়ান আর্থ- নামক বৈজ্ঞানিক সাময়িকী প্রকাশিত নিবন্ধে।
নিবন্ধের মূল লেখন এবং ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডের গবেষক ব্রুক উইলিয়ামস দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ''অখণ্ড প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান এবং বন্য পরিবেশের বড় অংকের ক্ষতির আশঙ্কা আমরা আগে থেকেই করেছিলাম। তারপরও, গবেষণার ফলাফল আমাদের স্তম্ভিত করেছে।''
''১৩ বছর পর আমরা দেখতে পাই; নির্মল হিসাবে যে ১১ লাখ বন-প্রান্তর চিহ্নিত করা হয়, তা-সহ প্রায় ২০ লাখ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলের সম্পূর্ণ বাস্তুসংস্থান হারিয়ে গেছে এ সময়ে। মর্মান্তিক এ ঘটনা ভাবলেও শরীরে আতঙ্কের হিমস্রোত বয়ে যায়। কারণ, পরিবেশ বিজ্ঞানী হিসেবে আমরা এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে ভালো করেই জানি। আমাদের গবেষণা দেখাচ্ছে, মানুষের কর্মকাণ্ডের পরিধি প্রতিনিয়ত নির্মল রয়েছে এমন বনভূমি এবং বাস্তুসংস্থান গ্রাস করতে আগ্রাসীভাবে এগিয়ে আসছে'' তিনি যোগ করেন।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়; ইন্দোনেশিয়া এবং পাপুয়া নিউগিনির বর্ষাবনের কথা। চিরসবুজ এ বনভূমি সমৃদ্ধ হাজারো রকমের জীববৈচিত্র্যে। এ বনের অধিকাংশ এখন মানুষের দখলে। প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানকে ধবংস করে তাকে পরিণত করা হয়েছে অর্থকরী ফসল চাষের কৃষি জমিতে। এসব শস্যের অন্যতম হচ্ছে; ভোজ্য তেল উৎপাদনের লক্ষ্যে করা পাম ফলের চাষ। বর্ষাবন ধ্বংসের অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে; বৈশ্বিক ভোক্তা বাজারের পাম তেল আসক্তি।
গবেষণাটিতে অবশ্য বন্য পরিবেশ ধ্বংসের কারণ চিহ্নিত করার প্রতি বেশি জোর দেওয়া হয়নি। তবে পাম চাষের প্রভাব ছিল খুবই সুস্পষ্ট। উইলিয়ামস জানান, ফসলটি চাষের জন্য যেভাবে যেভাবে বন পুড়িয়ে কৃষিজমি তৈরি করা হয়, সেটাই এর প্রধান কারণ।
নিবন্ধের সহ-লেখক এবং কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক বন্যজীবন সংরক্ষণ সোসাইটির সদস্য অধ্যাপক জেমস ওয়াটসন জানান, ''তথ্য ভুল করে না। ভুল হয় মানুষের তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়ায়। কিন্তু, অনেক বেশি সময় ধরে পর্যবেক্ষণে ভুল থাকার সম্ভাবনা দূর করা হয়েছে। সত্য এটাই যে, অন্য প্রজাতির টিকে থাকার জন্য যে ভূমি দরকার তা প্রতিনিয়ত মানুষ নামক শ্রেষ্ঠ জীবেরা দখল করে চলেছে।''
''জলবায়ু পরিবর্তনের এ যুগে পৃথিবীর সকল অপ্রভাবিত বাস্তুসংস্থান রক্ষায় আমাদের সক্রিয় তৎপরতা দরকার। নানা প্রজাতির বিলুপ্তি ঠেকানোসহ জলবায়ু ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে এর কোনো বিকল্প নেই'' ওয়াটসন যোগ করেন।
সার্বিক চিত্রের দিকে তাকালে একথার গুরুত্ব আরও বেশি অনুধাবন করা যায়। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন- ২০১৩ সাল নাগাদ ২২১টি জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে মাত্র ২৬টি'র প্রাকৃতিক ভূমি অপরিবর্তিত ছিল।
গবেষণায় জড়িত ছিলেন না এমন একজন বিশেষজ্ঞ এবং জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রপিক্যাল ইনভায়রোমেন্টাল অ্যান্ড সাস্টেইনেবিলিটি সায়েন্সের অধ্যাপক বিল লরেন্স বলেন, এর ফলাফল অত্যন্ত ভীতিজনক মনে হয়েছে।
''কোনো সন্দেহ নেই মানবজাতি পুরো পৃথিবীকে আবর্জনার ভাগাড়ে রূপান্তরিত করছে। সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকা; এখানে শুধু বনভূমি নয় বরং প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানও প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে, তৃণভূমি এবং স্থানীয় সাভানা বন হারানোর গতি ছাড়িয়ে গেছে কল্পনার সকল সীমা।''
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান