যে অঞ্চলে বয়ঃসন্ধির পর মেয়েরা পুরুষে রূপান্তরিত হয়!
ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের একটি রাষ্ট্র ডমিনিকান রিপাবলিক। এই দেশেরই ছোট একটি শহরে বাস করে জনি। বয়ঃসন্ধির আগ পর্যন্ত জনির বাবা-মা ভাবতেন, তাদের সন্তান আসলে একটি মেয়ে। জন্মের পর থেকে জনি দেখতে মেয়েদের মতো হলেও, বয়ঃসন্ধিতে পড়ার পর দেখা গেলো তার শরীরে পুরুষাঙ্গ স্পষ্ট হচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ডমিনিকান রিপাবলিকের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের আরও অনেক শিশুই বয়ঃসন্ধির পর তাদের সত্যিকার লিঙ্গ পরিচয় বুঝতে পারে!
বিবিসির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ডমিনিকান রিপাবলিকের এই অদ্ভুত অস্বাভাবিকতার কথা। জনি ও তার মতো আরও যারা আছে, তাদেরকে সেখানে ডাকা হয় 'গুয়েভেডোসেস' বলে। বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় 'পেনিস অ্যাট টুয়েলভ' বা '১২ বছরে এসে পুরুষাঙ্গ গজানো'।
জন্মের পর থেকেই জনির বাবা-মা তাকে মেয়ে ভাবার কারণ, তার শরীরে কোনো অণ্ডকোষ বা পুরুষাঙ্গ ছিলনা, বরং যোনিপথসদৃশ অঙ্গই ছিল। শুধুমাত্র বয়ঃসন্ধিকালে এসেই তার শরীরে পুরুষালি সব লক্ষণ দেখা যায়।
মেয়ে হিসেবে ধরে নেওয়ার কারণেই একসময় ফেলিসিটা নামে পরিচিত ছিল জনি। লালা জামা পরে স্কুলে যাওয়ার কথা এখনো মনে আছে তার। জনি বিবিসিকে জানায়, মেয়েলি কাজকর্ম করতে কিছুতেই ভালো লাগতো না তার।
"আমি মেয়েদের পোশাক পরতে অপছন্দ করতাম। আমার জন্য মেয়েদের খেলনা আনা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো দিয়ে আমি কখনোই খেলিনি । তার চেয়ে বরং কোথাও ছেলেদের বল খেলতে দেখলে, আমি সেই দলে যোগ দিতাম", বলেন জনি।
বয়ঃসন্ধিকালে যখন জনি পুরোপুরি একজন ছেলে হয়ে উঠলো, তখন স্কুলে নানা কটূক্তি শুনতে হলো তাকে। অনেকেই তাকে শয়তান, নোংরা বলে ডাকতে লাগলো। তবে জনি মুখ বুজে সহ্য করেনি, জবাবে শক্ত প্রতিবাদ করেছে সে।
কার্লা নামের আরও একটি মেয়ের দেখা পায় বিবিসি টিম। সাত বছর বয়সে এসে কার্লা থেকে কার্লোস হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল সে।
কার্লোসের মা জানালেন, "ওর পাঁচ বছর বয়সেই দেখতাম, আশেপাশে কোনো ছেলে বন্ধু থাকলে, তার সাথে মারামারি করতে চাইতো ও। ওর পেশি এবং বুক স্ফীত হচ্ছিলো। আমি বুঝতে পারছিলাম সে একজন ছেলে হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে ছেলে বা মেয়ে যাই হোক না কেন, আমি তাকে ভালোবাসি।"
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শুধুমাত্র ডমিনিকান রিপাবলিক অঞ্চলে এমন অস্বাভাবিকতার কারণ কি?
এটি নিয়ে সর্বপ্রথম যারা গবেষণা করেছিলেন, তাদের মধ্যে একজন হলেন নিউইয়র্কের কর্নেল মেডিক্যাল কলেজের ডা. জুলিয়ান ইমপারেটো-ম্যাকগিনলে। সত্তরের দশকে ডমিনিকান রিপাবলিকে ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। গিয়ে ঘটনার সত্যতা দেখতে পান এবং সেখানকার শিশুদের উপর ব্যাপক গবেষণা করেন তিনি। গবেষণায় দেখা যায়, ডমিনিক রিপাবলিকের এই শিশুরা একটি বিরল জিনগত রোগে আক্রান্ত।
যখন কেউ একজন গর্ভধারণ করে, মেয়ে হলে তার মধ্যে স্বভাবতই একজোড়া এক্স ক্রোমোজোম থাকে এবং ছেলে সন্তান হলে এক্সওয়াই ক্রোমোজম থাকে।
গর্ভের প্রথম কয়েক সপ্তাহে মেয়ে বা ছেলে, দুই লিঙ্গের ক্ষেত্রেই দুধের বোঁটা স্পষ্ট হতে থাকে। এরপর অষ্টম সপ্তাহে এসে সেক্স হরমোন জন্মায় শিশুর শরীরে। যদি ছেলে সন্তান হয়, তাহলে ওয়াই ক্রোমোজম ডিম্বাশয়কে অন্ডকোষে পরিণত হতে দেয়। সেই সাথে টিউবারকল নামক একটি কাঠামোর ভেতরে টেস্টোস্টেরন প্রবেশ করতে দেয়, যেখানে এটি ডিহাইড্রো-টেস্টোস্টেরনে পরিণত হয় এবং এটিই টিউবারকলকে পুরুষাঙ্গে রূপান্তর করে। কিন্তু যদি মেয়ে সন্তান হয়, তাহলে তার শরীরে ডিহাইড্রো-টেস্টোস্টেরন জন্মায় না এবং তার টিউবারকল ভগাঙ্কুরে (clitoris) পরিণত হয়।
ম্যাকগিনলে যখন 'গুয়েভেডোসেস' এর বিষয়ে অনুসন্ধান করেন, তিনি দেখতে পান ওই অঞ্চলের শিশুদের শরীরে ফাইভ আলফা রিডাকটেজ নামক একটি উৎসেচকের (enzyme) ঘাটতি রয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শরীরে যে জিনটি এই উৎসেচক তৈরির নির্দেশ বহন করে থাকে, তার মধ্যে কোনও সমস্যা দেখা দিলে এই উৎসেচক যথাযথ পরিমাণে উৎপন্ন হয় না।
ডমিনিকান রিপাবলিক অঞ্চলে এটি বেশ পরিচিত একটি সমস্যা, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বিশ্বের অন্য সব অঞ্চলে এটি বিরল। তাই ডমিনিকান অঞ্চলের ছেলেদের এক্সওয়াই ক্রোমোজম থাকা সত্ত্বেও, জন্মের সময় তারা মেয়েলি দেখতে হয়। কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালে আর দশটা ছেলের মতোই তাদের শরীরে আরও একবার প্রচুর পরিমাণ টেস্টোস্টেরন প্রবাহিত হয়। তাই সে সময় তাদের দেহ সাড়া দেয় এবং শরীরে পেশি, অন্ডকোষ ও পুরুষাঙ্গ পূর্ণরূপে প্রকাশ পায়।
ম্যাকগিনলের অনুসন্ধান থেকে আরও জানা যায়, বয়ঃসন্ধির পরে এসব ছেলেদের দেহে পুরুষাঙ্গ স্বাভাবিকভাবেই কাজ করে এবং তাদের কোনো শারীরিক সমস্যা হয় না। যদিও কেউ কেউ অপারেশনের মাধ্যমে নারী পরিচয়কেই বেছে নেন।
সূত্র: বিবিসি