আন্দোলন সফল করতে কত লোক লাগে?
কোন একটা আন্দোলন সফল হতে আসলে কতজন মানুষ লাগে? আন্দোলনে কত মানুষ অংশগ্রহণ করলে শাসককে উৎখাত করা যায়? এমন মজার প্রশ্ন নিয়ে কাজ করছেন এক গবেষক। তিনি তার গবেষণায় দেখলেন মোট জনসংখ্যার ৩.৫ শতাংশ অংশগ্রহণ করলে একটা আন্দোলন সফল হবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
উদাহরণ হিসেবে ১৯৮০ সালে পোল্যান্ডের আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা যায়। কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন, সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মেলোসেভিক এর উৎখাতের আন্দোলন অথবা মধ্যপ্রাচ্যের তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তের কথা বলা যায়।
স্মরণকালের মধ্যে এই আন্দোলনগুলোই বড়সড় রাজনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে বিশ্বের নানা প্রান্তে।
অতি সম্প্রতি বেলারুশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজেকে জয়ী ঘোষণা করে প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশ্যাঙ্কার। এর প্রতিবাদে দেশটির হাজার হাজার জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। প্রশাসন চড়াও হয় আন্দোলনকারীদের উপর। তাদের অনেককেই গ্রেফতার করা হয় এবং তাদের অনেকের উপর অত্যাচারের অভিযোগও আনা হয়। এরপরও শুরু থেকেই আন্দোলনটি ছিল শান্তিপূর্ণ।
তাহলে কি আন্দোলনটি সফল হতে চলেছে- এমনটা বলা যায়??
এর জন্য ইতিহাসের সমস্ত প্রতিবাদ আর আন্দোলনগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। আর সেই কাজটাই করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিকা চেনোয়েথ।
প্রফেসর চেনোয়েথ মূলত স্বৈরশাসনের অধীনে দেশগুলোর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করেছেন, গণতান্ত্রিক দেশগুলো বাদ দিয়েছেন। কেননা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপ্রধানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু একজন স্বৈরশাসককে ক্ষমতা থেকে সরানোর এমন কোন কাঠামো নেই।
তবে 'গণতন্ত্র' ও 'স্বৈরশাসন' এর মধ্যে সংজ্ঞাগত তফাৎ আছে। আবার এই দুই চরম পরিস্থিতির মাঝামাঝি পরিস্থিতিতেও অনেক দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ থাকতে পারে। যেমন কোন দেশ অনেক বেশি গণতান্ত্রিক আবার কোন দেশ মোটামুটি মানের গণতন্ত্র বরাজ করতে পারে। যা যাচাই করা কঠিন।
আবার সহিংসতার সংজ্ঞা নিয়েও ঝামেলা আছে। যেমন কোন আচরণ কারও কাছে সহিংস আবার কারও কাছে তেমন সহিংস নয়। কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি আক্রমণ করা কি সহিংস? আবার কোন ধরণের শারীরিক নির্যাতন না করে বর্ণবাদী গালিগালাজ করলে কি সেটা সহিংস হবে? কিংবা আমরণ অনশ্নে একজন মারা যেতে পারেন, তবু সেটা কি অহিংস না সহিংস?
এই ধরণের কিছু দ্বিধাপূর্ণ বিষয় থাকলেও কোন আন্দোলন সহিংস না অহিংস তার একটা সুস্পষ্ট রূপরেখা আছে। হামলার মাধ্যমে কাউকে হত্যা নিঃসন্দেহে সহিংস। আবার শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নেওয়া, ব্যানার-পোস্টার-লিফলেটের মাধ্যমে প্রচার, স্মারক উপস্থাপন করা স্পষ্টতই অহিংস আন্দোলনের উদাহরণ। এমনকি ১৯৮ উপায়ে অসিংস আন্দোলন করা যেতে পারে।
গবেষক চিনোয়েথ ও তার সহ লেখক মারিয়া স্টিফেন ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বের নানা প্রান্তের আন্দোলনগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। আর এই বিশ্লেষণ থেকে তারা বলছেন, আন্দোলন যদি অহিংস হয়, তবে তা সফল হবার সম্ভাবনা দ্বিগুণ হয়ে যায়।
কিন্তু কেন?
এর কারণ- সহিংস আন্দোলনের ক্ষেত্রে সমাজের বেশ কয়েকটি অংশের মানুষ অংশগ্রহণ করতে চায় না। অর্থাৎ আন্দোলনের সপক্ষের দল হালকা হয়ে যায়। আর যদি তা অহিংস উপায়ে হয়, তবে অনেক মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করতে নিরাপদ বোধ করে। আর অহিংস আন্দোলনে ঝুঁকি কম, কোন বিশেষ ধরণের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয় না। ফলে নারী-শিশু এমনকি বয়স্করাও এসব আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে পারে।
এটা কাজ করে কেন?
উদাহরণ হিসেবে সার্বিয়ার 'বুলডোজার আন্দোলন' কেই ধরে নেওয়া যাক। দেশটির প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মেলোসেভিক কে উৎখাতের জন্য জনগন আন্দোলনে নামে। সেদেশের সেনাবাহিনী আন্দোলনকারী জনগণের দিকে বন্দুক তাক করেনি। পরে তাদের এব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা জানান, সেই আন্দোলনকারীদের মাঝে তাদের বাবা-চাচা, ভাই-বাওনেরাও ছিল। নিজের পরিবারের উপর কেউ গুলি চালাতে পারে? অর্থাৎ আন্দোলন যত বড় হবে, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আত্মীয়দের থাকার সম্ভাবনাও বেশি।
আর ঠিক কত সংখ্যায় অংশগ্রহণকারী থাকলে আন্দোলন সফল হবে তাও নির্ণয় করেছেন প্রফেসর এরিকা- মোট জনসংখ্যার ৩.৫%। এটা শুনতে খুব কম মনে হলেও, আসলে খুব কম নয়। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি। এবার ১৬ কোটির ৩.৫% কত হয় বলুন তো?- ৫৬ লক্ষ!
এখন এই সংখ্যাটাই যে ধ্রুব সত্যের মতো মেনে চলতে হবে তা নয়। এর কম সংখ্যক আন্দোলনকারী থাকলেও তা সফল হতে পারে, ২০১১ সালে বাহরাইনের আন্দোলনের উদাহরণ দেন এরিকা চিনোয়েথ।
এই গবেষণা থেকে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন্ড খুঁজে পেয়েছেন তিনি। প্রথমত, ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে হওয়া আন্দোলনগুলো অন্য যেকোন দশকের চেয়ে অনেক বেশি অহিংস ছিল।
দ্বিতীয়ত, আন্দোলন সফল হবার পরিমাণ কিন্তু কমে গেছে। সহিংস আন্দোলনের সংখ্যা যেমন কমেছে, কমেছে সফলতার হারও। ২০০৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রতি ১০টি সহিংস আন্দোলনের মধ্যে ৯টিই ব্যর্থ হয়েছে। বরং অহিংস আন্দোলনের সফলতার পরিমাণ বেশি।
এর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উত্থানের কথা উল্লেখ করেন চিনোয়েথ। আন্দোলন আয়োজনের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দ্রুত মঞ্চ হিসেবে কাজ করে। খুব দ্রুত তথ্য জানিয়ে দেওয়া যায়। আর এক্ষেত্রে ভৈগোলিক দূরত্ব বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। একে অনেকে ডিজিতাল বিপ্লব বলেও উল্লেখ করেন।
তবে এর কিছু ক্ষতিকর দিকের কথাও উল্লেখ করেন এরিকা। তিনি বলেন, 'এক্ষেত্রে যেহেতু কোন নজরদারীর ব্যবস্থা নেই, ফলে ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির ঝুঁকি থেকে যায়। প্রোপাগান্ডা ছড়াতে পারেন যে কেউ'।
সূত্র: বিবিসি