ডিজিটাল মজুরিতে নারীর ক্ষমতায়ন

বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। শুধু পোশাক কারখানাতেই বর্তমানে ৩০ লাখের বেশি নারী কাজ করছেন। এই গার্মেন্টস খাতই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় জোগানদাতা। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ৪ শতাংশ, ৮০-র দশকে ৮ শতাংশ, ৯০ দশকের শেষে ২৩ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশ। তবে অংশগ্রহণ বাড়লেও এই সুদীর্ঘ সময় জুড়ে সম্পদের উপর নারীর অধিকার তেমন করে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ কারণে নারীর ক্ষমতায়নও সেভাবে বাড়েনি।
'বাংলাদেশের নারীদের স্বউপার্জিত টাকা বাবা বা স্বামীর হাতেই আগে তুলে দেওয়ার একটি প্রথা রয়েছে। এটা না করলে সহিংসতার শিকারও হতে হয়েছে অনেক নারীদের। সেই জায়গাটি বদলে দিয়েছে 'ডিজিটাল মজুরি'। কোভিড ১৯ মহামারির কারণে গোটা পৃথিবীই আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। তবে এই বিপর্যয়ের মধ্যেও বাংলাদেশে নারীদের ডিজিটাল মজুরি তাদের ক্ষমতায়নে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে।'
বিশ্বব্যাঙ্কের প্রকাশিত 'গ্লোবাল ফাইন্ডেক্স ২০২১' বিশ্লেষণ করে এমনই মন্তব্য করেছেন স্নিগ্ধা আলি। স্নিগ্ধা ওয়াশিংটনের 'বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনে' গরীবদের আর্থিক সহায়তা বিষয়ক কর্মসূচির (HER PROJECT) প্রোগ্রাম অফিসার।
বাংলাদেশের ডিজিটাল মজুরি কীভাবে নারীদের ক্ষমতায়নে কাজ করছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, আগে কারখানায় মজুরি দেওয়ার দিন আগে থেকেই পুরুষ অভিভাবকদের টাকার জন্য বিভিন্ন ফ্যাক্টরিগেটে লাইন দিতে দেখা যেত। এখন সবটাই ডিজিটাল। যে কারণে সে লাইন আর তেমন একটা চোখে পড়ে না।
এখন নারী তার মজুরি বা বেতন যেটিই বলুন সেটা সে পাচ্ছে তার নিজস্ব ডিভাইসে বা সরাসরি চলে যাচ্ছে তার ব্যাংকে। যে কারণে নিজের উপার্জিত অর্থ সে স্বাধীনভাবে ভোগ করতে পারছেন।' তার মতে সরকারের প্রণীত ডিজিটাল মজুরি নারীর স্বাধীনতা বাড়িয়েছে।
সিলেটের সুইটি নামে ১৯ বছরের এক নারী পোশাক শ্রমিকের উদাহরণ টেনেছেন স্নিগ্ধা। সুইটি সিলেটে তার মা ও দুই ভাইয়ের সঙ্গে বড় হচ্ছিলেন। তার বাবা ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত। ১৭ বছর বয়সে সুইটিও পোশাক কারখানায় নিযুক্ত হন। প্রথমবার নগদ টাকায়মজুরি পেয়ে খুব আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু পরক্ষনেই তা তুলে দিতে হয়েছিল তার পরিবারের হাতে। তখন তিনি বুঝতে পারেন নগদ টাকা হাতে পেলেও এই টাকা ভোগ করার কোন স্বাধীনতা তার নেই।
পরবর্তিতে যখন কারখানা শ্রমিকদের মজুরি ডিজিটাল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন সুইটি বুঝেছিল, এবার টাকা জমাতে সুবিধা হবে। স্নিগ্ধাকে সে বলেছে, 'প্রথম দিকে একটু ভয়ই করছিল। ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না। এখন নিজেই এটিএম থেকে টাকা তুলতে পারি।'
সুইটি আরও জানিয়েছে, 'বিজনেস ফর সোস্যাল রেসপনসিবিলিটি' তাদের এটিএম থেকে টাকা তোলা শিখিয়েছে। ফলে আর কোনও অসুবিধা নেই। বরং খরচা কমিয়ে তাকে সঞ্চয়মুখী করেছে ডিজিটাল মজুরি।
আর্থিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ও অর্ন্তভূক্তির সুইটি একটি সফল উদাহরণ মাত্র। গোটা দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ নারী এখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় অগ্রগতি করছেন। স্নিগ্ধা গ্লোবাল ফাইনডেক্স ২০২১-কে উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন, তার নিজের দেশ বাংলাদেশ থেকে শুরু করে বহু দেশ ২০১৭ সাল থেকে আর্থিক অন্তবর্তীকরণের দিকে অগ্রসর হয়েছে।
আফ্রিকা মহাদেশে সাহারার দক্ষিণাঞ্চল, ল্যাটিন আমেরিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি লোকের এখন ব্যাঙ্ক বা কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। বাংলাদেশেও বিকাশের মতো মোবাইলে টাকা প্রদানকারী সংস্থার সাথে অনেকে যুক্ত। গত এক দশকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাউন্ট খোলার প্রবণতা এদেশে ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
অ্যাকাউন্ট খোলায় পুরুষদের তুলনায় নারীরা আগে পিছিয়ে ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের পর থেকে নারীদের মধ্যেও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির প্রবণতা বাড়ছে। কোভিড অতিমারি নারীদের আরও বেশি করে ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহিত করে। স্নিগ্ধার মতে, বেসরকারি সংস্থাগুলিও ডিজিটাল মজুরি প্রদানে উৎসাহিত হওয়ায় বহুদেশ টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে অবকাঠামো উন্নয়নে মন দিয়েছে।
মহামারি-প্ররোচিত আর্থিক অন্তর্ভুক্তি: ডিজিটাল হচ্ছে ঢাকা
গেটস ফাউন্ডেশনের এইচইআর (HER PROJECT) প্রজেক্টটি বাংলাদেশে ডিজিটাল মজুরির মাধ্যমে নারীদের আর্থিক অন্তবর্তীকরণে কাজ করছে।
বিশ্ব ব্যাংকের গ্লোবাল ফাইনডেক্স ২০২১ প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে স্নিগ্ধা জানান, গত ৪ বছরে বাংলাদেশের নারীদের ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট বেড়েছে ৭ শতাংশ। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে লিঙ্গ ব্যবধান কিছুটা কমানো সম্ভব হয়েছে।
কোভিডের সময় পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত যেসব নারীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই তাদের মোবাইল সংস্থাগুলির মাধ্যমে ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। গ্যাপ এবং ইন্ডিটেক্সের মতো আন্তর্জাতিক ব্রান্ডের পাশাপাশি বাংলাদেশেরও বহু সংস্থা মহামারির আগেই পোশাক শিল্পে ডিজিটাল মজুরি চালু করতে চেয়েছিল।
২০১৯ সালে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলি এবিষয়ে সহমতে পৌঁছায়। কিন্তু কয়েক মাস পরেই কোভিডের কারণে লকডাউন ঘোষিত হয়। লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ হারিয়ে ব্যাপক অর্থ সঙ্কটে পড়েন।
তখন বাংলাদেশ সরকার বন্ধ পোশাক কারখানার শ্রমিকদের মজুরির স্বার্থে কম সুদে পোশাক উতপাদনকারীদের ঋন দেন। লকডাউনে শ্রমিকদের ডিজিটাল মাধ্যমেই মজুরি দিতে হয়। ফলে মাত্র দু সপ্তাহের মধ্যে ২০ লক্ষ ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট খোলা হয় গোটা দেশে।
কোভিড মহামারির আগে পোশাক শ্রমিকদের মাত্র ২৮ শতাংশ ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট ২০২০ সালের মে মাসে সেটা পৌঁছায় ৭৬ শতাংশে। আর্থিক অন্তবর্তীকরণে বাংলাদেশ এগিয়ে যায় কয়েক কদম। আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থায় নারীরাও এগিয়ে আসেন।
এ বিষয়ে কথা বলেছেন নারায়নগঞ্জের সিকোটেক্সট ফেব্রিক্স লিমিটেডের পরিচালক মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, করোনা মহামারির মাঝামাঝি সময়ে আমাদের কাছে সরকার থেকে নির্দেশ এলো শ্রমিকদের বেতন ডিজিটাল মাধ্যমে প্রদান করার। আমরা তখন থেকে বিকাশের মাধ্যমে বেতন পরিশোধ শুরু করি।
প্রতিবার বেতন পরিশোধের সময়ে বিকাশকে কমিশন বাবদ একটা এমাউন্ট আমাদের দিতে হতো। প্রায় ১৪ শো শ্রমিকের বেতন দ্রুত পরিশোধের এই ব্যবস্থা আমাদের শ্রম ও সময় অনেক বাঁচিয়েছিল। পাশাপাশি শ্রমিকরাও বেশ খুশি ছিল নগদ টাকা পরিবহন করতে হচ্ছে না এই ভেবে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই শ্রমিকদের মধ্য থেকে নগদে টাকা পরিশোধের চাপ আসা শুরু হলো। খোঁজ নিয়ে জানা গেল শ্রমিকদের অনেকেই বিকাশ পিন ভুলে যাচ্ছেন।
তাছাড়া বিকাশের দোকান থেকে টাকা তুলতে যেয়ে প্রতারণার শিকারও হতে হয়েছে কয়েকজনকে। এখন আমরা ব্যাংকের মাধ্যমে বেতন পরিশোধের বিষয়টি ভাবছি। শ্রমিকদেরকে ডিজিটাল আর্থিক অর্ন্তভুক্তির বিষয়ে আরও অধিকতর প্রশিক্ষণের ওপরে জোর দেন তিনি।
ডিজিটাল মজুরির সুবিধা
ডিজিটাল মজুরির কী কী সুবিধা? কোভিড-১৯ এর ধাক্কা সামলানোর ক্ষেত্রে ডিজিটাল অর্থপ্রদান এবং পুনরুদ্ধার হওয়া অর্থনীতির প্রবণতাকে নিরস্ত্র করা কঠিন। ক্ষুদ্রঋণের সুযোগ সংক্রান্ত বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, ডিজিটাল মজুরি বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা প্রশমিত করেছে।
২০২০ সালের মাঝামাঝি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা প্রায় ৫০ শতাংশ এবং ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশে হ্রাস পায়। স্নিগ্ধার মতে, এখন বিশ্বব্যাপী পোশাকের চাহিদা নতুন করে উদ্দীপিত হয়ে প্রাণবন্ত অর্থনৈতিক প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তহীনতা এখন ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। তার মতে, ডিজিটাল মজুরি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রদান করে। ফলে মালিক ও শ্রমিক উভয়পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক এবং প্রত্যেকের জন্য নিরাপদ।
ডিজিটাল মজুরি বাড়ায় সঞ্চয়ের প্রবণতা
সঞ্চয় প্রবণতা অনেকটা বাড়িয়েছে ডিজিটাল মজুরি। সিলেটের সেই সুইটি এখন নিজেই গড়ে তুলেছে নিজস্ব বাসস্থান। নিজের টাকায় বিয়ের জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। বিশ্বব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে অন্তত ২৫ শতাংশ নারীর মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা গড়ে উঠেছে।
প্রবাসী শ্রমিকদের গ্রামে তাদের বাড়িঘরে অর্থ পাঠানোর পরিমাণ বেড়েছে ২৬ শতাংশ। অতিদারিদ্রতা কাটিয়ে উঠতেও সাহায্য করছে নিচ্ছে ডিজিটাল মজুরি।
দরিদ্রদের জন্য আর্থিক পরিষেবা
২০২০ সালের আগস্ট মাসে মজুরিতে সরকারি সহায়তা বন্ধ হতেই বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ফের ডিজিটাল মজুরি প্রদান কমতে থাকে। ডিজিটাল মজুরি কমে হয় ৫৬ শতাংশে। তবে এটাও আগের তুলনায় বেশি। ডিজিটাল মজুরির স্বার্থকতা হচ্ছে আগে ৪ শতাংশ নারী সম্মতি দিয়েছিলেন। এখন সেটা ৮১ শতাংশই ডিজিটালের পক্ষে। সঞ্চয়ের হার ৩৬ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭০ শতাংশ।
তাই সুইটির মতো নারীরা আজ বলছেন, 'আম্মু বা নানীর থেকে অনেক ভালো আছি। আমার মতো টাকার স্বাদ তারা পায়নি। গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে আজ আমি কাজ করছি। টাকা জমাচ্ছি। এটাই তো অনেক।'