‘তবে আসো, আরেকবার স্বাধীন হই’

"যে মেয়েটা ভোর না হতেই
মায়ের সঙ্গে যাচ্ছে কাজে,
যে মেয়েটা পরের বাড়ি
কাপড় কাচে, বাসন মাজে,
যে মেয়েটা গোবর কুঁড়োয়
ঘুটে ও দেয় কয়লা বাছে
যে মেয়েরা সারা জীবন
পায় না আদর কারো কাছে!
ওদের কাছে প্রশ্ন করো, ওরা কি কেউ সত্যি জানে,
স্বাধীনতা দেখতে কেমন? স্বাধীনতার সঠিক মানে!"
পরাধীনতার শেকল ভেঙে স্বাধীন সূর্য পানে আমাদের পদযাত্রা শুরু হয় আজ থেকে ৫০ বছর আগেই। তবে স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পেরিয়েও কি আমরা বলতে পারি, 'আমরা প্রকৃত স্বাধীন?'
উত্তরটা যদি 'হ্যাঁ' হয়, তাহলে কেনো বাল্যবিবাহের শিকার স্কুলপড়ুয়া মেয়েগুলো শিক্ষার স্বাধীনতা পায় না? ১৮ বছর বয়সী প্রাপ্তবয়স্ক তরুণ- তরুণী কেন ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার বা উচ্চশিক্ষার বিষয় নির্ধারণের স্বাধীনতা রাখে না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের স্বনামধন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রী কেনো রাস্তা দিয়ে নির্ভয়ে হাটার স্বাধীনতা পায় না?
৭-৮ বছরের যে বাচ্চাগুলোর ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, একটি স্বাধীন দেশে বাস করে খাদ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি মৌলিক অধিকার পূরণের জন্য তাদেরকে কেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুল কিংবা খবরের কাগজ বিক্রি করতে হচ্ছে?
২১ বছর জীবনটা হয়তো খুবই ছোট, তবে এই ছোট্ট জীবনে অনেক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। আর সেই অভিজ্ঞতাগুলো বিবেকের কাছে প্রশ্ন হয়ে ধরা দিয়েছে, যার উত্তর আজও পাইনি।
আজকাল ফুটপাতের সেই রাবেয়ার কথা ভীষণ মনে পড়ে। টিফিনের টাকা দিয়ে যাকে 'অ,আ,ক,খ' এর বই কিনে দিয়েছিলাম আর পৃথিবীর সব সুখ যেন হাসি হয়ে তার মুখে ফুটে উঠেছিল। পৃথিবীতে কাউকে খুশি করতে পারার আনন্দের চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছুতে নেই। রাবেয়া আমাকে বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলেছিল, 'একটা বই কিনা দিবেন, পড়মু!' সেদিন মনে মনে ভেবেছিলাম, যদি কোনোদিন আল্লাহ আমাকে সামর্থ্য দেয় তাহলে রাস্তায় থাকা ছেলেমেয়েগুলোর পড়াশোনার দায়িত্ব নেবো।
আর বেগুনবাড়ি বস্তির সেই ফুলি,যার খুশির আনন্দে নিজেই কেঁদে ফেলেছিলাম। করোনার কঠিন সময়ে আমরা স্বেচ্ছাসেবকরা ঠিক করলাম, আমাদের সংস্থা থেকে ঢাকার কিছু বস্তিতে খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করবো। সেরকমই একদিন যখন বেগুনবাড়ি নামের একটা বস্তিতে গেলাম, সেখানে গিয়ে দেখলাম একটা ৭-৮ বছরের বাচ্চা মেয়ে ঘরের বাইরে দাড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। কাছে গিয়ে যখন জানতে চাইলাম তখন সে বলল, তার বাবা-মায়ের ভীষণ জ্বর, কিন্তু আশেপাশের কেউই তাদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইছে না। কারন হলো, ফুলির বাবা- মাকে ছুঁলে তাদের করোনা হয়ে যাবে। আজকাল মনে হয় 'বিবেক আর মনুষ্যত্ব' ব্যাপার দুটি উঠেই গিয়েছে মানুষের মন থেকে। নাহলে কেউ এরকম কাজ করতে পারে না।
আমরা স্বেচ্ছাসেবকরা যখন ফুলির বাবা মাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম তখন ফুলিও খুশি হয়েছিলো, ঠিক যেরকম খুশি রাবেয়া একদিন হয়েছিল।
আমি এমন একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, যেখানে থাকবে না কোনো পরাধীনতার শেকল। থাকবে না ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য। রাস্তায় বের হলে যাদের ফুল-খবরের কাগজ বিক্রি করতে দেখা যায়, তাদেরকে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যেতে দেখা যাবে। বস্তিতে থাকা রাবেয়ার অসহায়ত্বের সুযোগ না নিয়ে, মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়ে সকলে এসে রাবেয়ার পাশে দাঁড়াবে।
খুব বেশি কিছু না। শুধু এটুকুই তো চাওয়া!
"স্বাধীনতার সঠিক মানে কজন স্বজন সত্যি জানে?
স্বাধীনতার সংজ্ঞা খুঁজো, শেকল ছেঁড়া পাখির গানে।"
জয় হোক প্রজন্মের এবং স্বাধীনতা নামের পাখিটি নিঃশঙ্কচিত্তে ডানা মেলুক সম্ভাবনার আকাশে।