সাক্ষাৎকারে যবিপ্রবি ভিসি: পরীক্ষা নিতে না পারলে সেশনজট দীর্ঘস্থায়ী হবে
ড. মো. আনোয়ার হোসেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। জাপানের কচি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের কালচারাল ফিশারিজ বিভাগে এবং জার্মানির রাইন ওয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের হাইজিন অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি কমনওয়েলথ, মনোবসু, ইউনেসকো, এফওবিএমবি, ফিডা ফাউন্ডেশন ইত্যাদি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে বৃত্তি ও ফেলোশিপ অর্জন করেছেন। ২০১১ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের শ্রেষ্ঠ গবেষকের পুরস্কারে ভূষিত হন।
করোনার কারণে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমে ক্ষতি ও সেখান থেকে উত্তরণে সুপারিশসহ নানা বিষয় নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের (টিবিএস) সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
সাক্ষাৎকার
টিবিএস: শিক্ষার ওপর করোনাভাইরাসের কী ধরনের প্রভাব পড়ল? করোনা তো সহসাই বিশ্ব থেকে বিদায় নিচ্ছে না। একটা শিক্ষা বছর শেষ হওয়ার পথে। পরবর্তী বছরে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বা ক্ষতি কমিয়ে আনতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন: করোনার বিরূপ প্রভাবে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের শিক্ষা কার্যক্রম থমকে গেছে। ক্লাসের মধ্যে শিক্ষার্থী-শিক্ষক মুখোমুখি হয়ে শিক্ষা গ্রহণ ও পাঠদান করা আর অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি এক নয়; কারণ শিক্ষার্থীদের সাথে 'আই কনট্যাক্ট' ও 'বডি ল্যাঙ্গুয়েজ' শিক্ষার একটি বড় মাধ্যম। অনলাইনে সেটা সঠিকভাবে হয় না। আজকে ৭-৮ মাস হলো কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরাসরি পাঠদান বন্ধ রয়েছে। আমাদের সবকিছু ডিজিটাল হলেও এখনো সর্বত্র ওই মানের ডিজিটাল সুবিধা নেই যা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও ঘরে ঘরে শিক্ষাসেবা পৌঁছে দিতে পারবে।
টিবিএস: করোনা পরিস্থিতিতে এবং করোনা পরবর্তী শিক্ষার গতিপথ কোন দিকে যাবে বলে মনে করছেন?
অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন: হয়তো এই করোনা মহামারি কেটে যাবে, পৃথিবী শান্ত হবে। তবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই বড় ধরনের প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আসবে। এটা অনলাইন বা ডিজিটাল মাধ্যমেই বেশি হবে এবং এর বড় ধরনের উন্নয়ন ঘটবে। দূরশিক্ষণ পদ্ধতি আরও শক্তিশালী হবে। আমার জানামতে, বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বাংলাদেশে থেকেই ক্লাস করছে এবং পরীক্ষা দিচ্ছে। আমাদের দেশেও এ পদ্ধতি এক সময় দাঁড়িয়ে যাবে।
আমরা অনলাইনে ক্লাস শেষ করছি; কিন্তু পরীক্ষা নিচ্ছি না। শিক্ষার্থীরা হয়তো দুইটা সেমিস্টার পর্যন্ত ক্লাস করবে। কিন্তু তৃতীয় সেমিস্টারে গিয়ে তারা পরীক্ষা না হলে আর ক্লাস করতে চাইবে না, কারণ পরীক্ষা না হলে তারা যথাসময়ে সনদ পাবে না। এ ছাড়াও, পরীক্ষা ও তার ফলাফল পড়াশোনার ক্ষেত্রে একটা বড় প্রেষণা হিসেবে কাজ করে।
টিবিএস: অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধকতাগুলো কী? সেগুলো কি একেবারেই সমাধানযোগ্য নয়?
অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন: বাংলাদেশে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা যে হচ্ছে, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে তা সমাধানের জন্য সবাই আন্তরিকভাবে কাজ করছে। যখন আমরা সমাধানের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি, তখন এটা কখনো ৫০ ভাগ বা ৭০ ভাগের মতো সমাধান হচ্ছে। আমাদের দেশে কোনো একটা কাজ শুরুর আগে আমরা তার সমাধান চাই। কাজ শুরু না করলে সমাধান আসবে না। বাস্তবে একটা কাজ শুরু করলেই কেবল আমরা বুঝতে পারব, কোনটি আজকে সমাধান করা যাবে, কোনটি পরবর্তী দিন সমাধান করা যাবে। কাজ শুরু না করলে এটা বুঝা যায় না।
পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদেরকেও এগিয়ে যেতে হবে। যতদিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হচ্ছে, ততদিন বিকল্প উপায়ে কাজ চালিয়ে যেতে হবে; আমাদের থেমে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
টিবিএস: বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় কেন পিছিয়ে থাকছে? শিক্ষকদের দক্ষতার ঘাটতি, নাকি কারিকুলাম, নাকি শিক্ষার্থীদের জ্ঞানগত সমস্যা?
অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন: আমাদের শিক্ষার্থীরা পৃথিবীর যেকোনো দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার যোগ্যতা রাখে। তাদের মেধা, মনন এবং গ্রহণ করার যোগ্যতা ঈর্ষণীয়। আমাদের কারিকুলামে একটু ঘাটতি আছে। সেটা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। আর দেশের যেসব পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সেগুলোতে অনেক বিশ্বমানের শিক্ষক আছেন। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকদের মান অনেক ভালো। তবে রাজনীকিকরণের ফলে শিক্ষকদের মান এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেখান থেকে শিক্ষাকে উঠিয়ে আনতে না পারলে ইতিবাচক কোনো কিছুই হবে না।
একজন শিক্ষক বা শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে না পারলে সৃষ্টিশীল হতে পারবেন না, এটা সত্য। বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় রাজনৈতিক মহামারি দেখতে পাচ্ছি। শিক্ষা থেকে রাজনীতি দূর করতে হবে। যে সকল প্রতিষ্ঠান জাতি গঠনে ভূমিকা রাখছে, অন্তত সেসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত রাখা উচিত।
টিবিএস: প্রাথমিক-মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার ঘাটতি কি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় কোনো প্রভাব বিস্তার করে?
অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন: এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এ ঘাটতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় প্রভাব বিস্তার করে। বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটা জায়গা যেখানে একজন শিক্ষার্থী আসেন, যার বয়স ১৮-২০ বছর। একজন শিক্ষার্থীকে আমরা ইংরেজি শেখাচ্ছি। তার ইংরেজি বা বাংলা ভাষার জ্ঞানটা যদি আগের স্তরেই মজবুত না হয়, তাহলে তার মধ্যে যোগাযোগ দক্ষতার ঘাটতি দেখা যায়। এটা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় এসে মেটানো যায় না। প্রকৃত শিক্ষা শুরু হয় প্রাথমিক পর্যায় থেকেই।
প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা পদ্ধতিকে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষার্থীকে আনন্দের সাথে শিক্ষা দিতে হবে। প্রথম ১২ বছর একজন শিক্ষার্থীকে এমনভাবে শেখানো উচিত, যেন সে জীবনে চলতে পারে। আর উচ্চ শিক্ষা হচ্ছে 'ভ্যালু অ্যাডেড' শিক্ষা। যেমন, একটি বীজ থেকে ফসল হওয়া পর্যন্ত অবস্থাকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাটা হলো এই ফসলকে আরও কীভাবে উন্নত ও অধিকতর উপযোগী করে তোলা যায়, সেই শিক্ষা।
টিবিএস: ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, শিল্পায়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার, জনশক্তি রপ্তানি- সব ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম দক্ষ জনশক্তি তৈরি করছে? যদি করেই থাকে, তবে কেন প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বিদেশি অতি-উচ্চ বেতনে আমাদের এখানে কাজ করছে? যদি না করে থাকে, তবে করণীয় কী?
অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন: আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে যে কারিকুলামে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, সেটা উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে আমরা মনে হয় না। বাইরে থেকে অনেক গ্রাজুয়েট বাংলাদেশে আসছে, এটা ঠিক। কিন্তু তারা যে আমাদের গ্রাজুয়েটদের চেয়ে ভালো, সেটা আমি বলব না। এ ক্ষেত্রে আমাদের শিল্পপতিদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। তবে এটাও ঠিক, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় এমন জনশক্তি তৈরি করছে, যার সাথে মার্কেটের চাহিদার সাথে মিল নেই। ফলে কিছু সমস্যা আমাদের আছে।
তবে আমাদের এমন গ্রাজুয়েট আছেন, যাদের সামান্য প্রশিক্ষণ দিলেই তারা কর্ম জগতে অনেক ভালো করতে পারবেন। আমাদের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান যেহেতু বহির্বিশ্বে ব্যবসা-বাণিজ্য করে, তাই তাদের 'মাইন্ডসেট' হলো বিদেশ থেকে লোক এনে 'শোকেস' হিসেবে রাখা এবং বলা যে, 'দেখো অনেক বিদেশি লোক আমার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে।'
এ ধরনের একটা সাইকোলজি আমাদের শিল্পপতিদের মধ্যে বিরাজমান, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাইরে থেকে এ দেশে অনেকে যে কনসালটেন্সি করতে আসে, তারা কিন্তু খুব মেধাবী না। প্রথম গ্রেডের বিদেশিরা কনসালটেন্সি করার জন্য আসে না। আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে যদি মার্কেটের চাহিদা অনুযায়ী আরেকটু সুদৃষ্টি দিয়ে তৈরি করা যায়, তাহলে ঐ সকল কনাসালটেন্টের চেয়ে তারা খারাপ করবে না।
টিবিএস: কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিতে বলছেন সবাই। আমাদের কারিগরি শিক্ষা যুগপোযোগী জনশক্তি গড়ে তুলতে কতটা সক্ষম? এক্ষেত্রে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়, যেখান থেকে সর্বোচ্চ উপযোগ মিলতে পারে?
অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন: কারিগরি শিক্ষার দুইটি লক্ষ্য: একটি হচ্ছে দেশের চাহিদা মেটানো এবং অপরটি হলো বিদেশের মার্কেট ধরা। বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি বিদেশে রপ্তানি করতে পারলে, আমাদের রেমিটেন্স অনেক বেড়ে যাবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ফিলিপাইন কম সংখ্যক জনশক্তি দিয়ে অধিক রেমিটেন্স আয় করে। তাই কারিগরি শিক্ষার জন্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশের চাহিদা মোতাবেক সেটা সাজাতে হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা জনশক্তি রপ্তানি করছি, সেই ক্ষেত্রগুলোতে ঠিকমতো কারিগরি শিক্ষা দিয়ে অধিক হারে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে।
পৃথিবীতে আমরা 'ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট' দেশ। এ জায়গাটা ম্যানেজ করতে পারলে দেশ অনেক কিছু পাবে।
টিবিএস: উচ্চশিক্ষার সংকট কোথায়? কাঙিক্ষত মানের চেয়ে পরিমাণের দিকে বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন?
অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন: দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী যদি শিক্ষা না দেওয়া যায়, অ্যাসেসমেন্ট না হয়, তাহলে কোনো বিভাগ থেকে যখন একজন গ্রাজুয়েট বের হবে, তখন সে কী করবে? একজন শিক্ষিত মানুষের ভালো করার ক্ষমতাও যেমন বেশি, খারাপ করার ক্ষমতাও বেশি। তার পেটে যেখন ক্ষুধা থাকবে, তখন সে কী করবে- এটা আমরা সকলেই বুঝি। সুতরাং, দেশের কোন জায়গায় কতটুকু প্রয়োজন, এটা নির্ধারণ করতে হবে আগে। তা না হলে এ শিক্ষা ব্যবস্থা হবে 'পেট মোটা মাথা চিকন' অবয়বের মতো। আমাদেরকে মান এবং সংখ্যা- উভয়ের ওপরই জোর দিতে হবে।
টিবিএস: উচ্চশিক্ষায় মানের চেয়ে বর্তমানে পরিমাণের দিকে অধিক নজর দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ মিলছে। আপনি কী মনে করেন? জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রক্রিয়া কেন?
অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন: জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করলে শুরুতেই নজর দিতে হবে স্থাপনার দিকে। যে সকল বিভাগ খোলা হবে, সেখানে ক্লাস শুরুর আগেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। নিয়োগ দিতে হবে প্রয়োজনীয় লোকবল। সবকিছু প্রস্তুত হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা আসবে।
এখন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হচ্ছে; কিন্তু সেগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে এবং স্থাপনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের জন্য যে গ্রাজুয়েট তৈরি করার কথা, সেটা করা সম্ভব হচ্ছে না; কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে অনেক দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে এবং সেটা মেটাতে গিয়ে এমন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, যারা এ দুর্বলতা কাটাতে পারছেন না।
একজন দুর্বল শিক্ষক তার অ্যাকাডেমিক জ্ঞানের ঘাটতি চাপা দেওয়ার জন্য অপরাজনীতিসহ নানারকম অপশক্তির আশ্রয় নিয়ে নিজের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করেন। দুর্বল শিক্ষকদের এমন কর্মকাণ্ডের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয়সহ বিভিন্ন ধরনের অপরাজনীতি ঢুকে যাচ্ছে। তাদের চাপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শেষ পর্যন্ত তাদের মান বজায় রাখতে পারছে না। এগুলো আগে ঠিকঠাক করে যদি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যায়, তাহলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনের জন্য দক্ষ গ্রাজুয়েট তৈরিতে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সক্ষম হবে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কারিগর ভালো না হলে প্রোডাক্ট ভালো হয় না। বাংলাদেশে বর্তমানে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে, সেখান থেকে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দক্ষ শিক্ষক যোগান দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর পর উচ্চ শিক্ষার প্রসারে জোর দিতে হবে।
টিবিএস: দক্ষ শিক্ষক তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে কি? বেতন-ভাতা নিয়ে যে অভিযোগ রয়েছে, তা কিছুটা হলেও সমাধান হয়েছে। এখন শিক্ষার মান উন্নত হচ্ছে কি?
অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন: দক্ষ শিক্ষক তৈরির করার জন্য সঠিক প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই। ফলে, অর্জিত জ্ঞান বিতরণের ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যা অনেক শিক্ষকের রয়েছে। একজন শিক্ষক ভালো পড়াশোনা করেন, ভালো জানেন। কিন্তু 'কমিউনিকেশন স্কিল' ভালো না থাকায়, সঠিকভাবে শক্ষিাদান দিতে পারেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়:
১. গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়: এখানে উচ্চমানের গবেষক এবং জনবল তৈরি করা হয়। তারা নিজের এবং দ্বিতীয় ধাপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অথবা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাপোর্ট দিতে পারবেন। একইসঙ্গে নতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারবেন।
২. দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের বিশ্ববিদ্যালয়: তাদের অন্যতম কাজ হচ্ছে দেশ-বিদেশের জন্য প্রয়োজনে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা।
৩. শিক্ষকদের বেতন: 'উনি শিক্ষক, ওনার ক্ষুধা লাগে না'- এ ধরনের ভাবনার দিন চলে গেছে। এখন শিক্ষকতা হচ্ছে নির্দিষ্ট কর্মসংস্থানের স্থান। আর সার্কভুক্ত দেশগুলোর সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশের শিক্ষকেরাই সবচেয়ে কম বেতন পান। ফলে অধিক যোগ্য শিক্ষার্থীরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।
শিক্ষকতাকে আকর্ষণীয় করতে না পারলে, ভালো শিক্ষক পাওয়া যাবে না।
টিবিএস: আপনার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্বপ্ন কী? কোথায় দেখতে চান একে? কীভাবে তা বাস্তবায়ন করবেন? এটি কতটা বাস্তবসম্মত?
অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন: বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে আমি একটাই স্বপ্ন দেখি, সেটি হলো এ বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটি গবেষণাধর্মী উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়। অপরাজনীতি এ বিশ্ববিদ্যালয়কে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল, এটি অচল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছিল। সেখান থেকে এ পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের কাছেও আমি দারুণভাবে কৃতজ্ঞ, যারা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটা নোংরা পরিবেশ থেকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে এসেছে।
আপনারা অত্যন্ত খুশি হবেন যে, এটা ছোট্ট একটা বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্তু এখানে অনেকগুলো গবেষক দল রয়েছে, যারা বিশ্বের অনেক নামকরা গবেষণা সাময়িকীতে গবেষণাপত্র প্রকাশ করছে। প্রথম দুই বছর ছিল আমার যুদ্ধের বছর। যুদ্ধ শেষে যখন শান্তির পায়রা হাতে পেলাম, তখনই এলো করোনা। এরই মধ্যে আমার শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা এ বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। আমরা যদি আরেকটু সুযোগ পাই, একটু পরিবেশ পাই, অপরাজনীতিমুক্ত হতে পারি, তাহলে আমি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি, এ বিশ্ববিদ্যালয় হবে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়।
সেই ধারায় এ বিশ্ববিদ্যালয় এগোচ্ছে এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও গবেষণাগারসমূহ সমৃদ্ধ হচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ আস্থা ও বিশ্বাস যবিপ্রবি পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের প্রতি আমার রয়েছে।