কন্টেইনার হাউজ: নাগরিক একঘেয়েমি থেকে মুক্তি
ঢাকার বিশৃঙ্খল জনজীবন থেকে মুক্তি পেতে একজন গ্রাহক কিছুটা আলাদাভাবে নিজের বাড়ি বানাতে চেয়েছিলেন। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নিজের জমিতে তিনি এ বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা করেন।
'রিভার অ্যান্ড রেইন' স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানের স্থপতিরা শিপিং কন্টেইনার দিয়ে বাড়ি বানানোর চিন্তা করেন, তাদের পরিকল্পনা সেই গ্রাহকেরও পছন্দ হয়ে যায়। তবে বাংলাদেশে শিপিং কন্টেইনারের বাড়ি তৈরি খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিল না।
তবে শেষ পর্যন্ত ২০১৭ সালে 'এসকেপ ডেন' নামের বাড়িটি নির্মাণের পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখে।
বেশিরভাগ স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানই শুধু বাড়ির নকশা করে দেয়ার কাজ করে, পরবর্তীতে তৃতীয় কোনো পক্ষকে নির্মাণের কাজ তদারকির কাজে নিয়োগ দেয়া হয়। তবে এসকেপ ডেন নামের ব্যতিক্রমধর্মী বাড়িটি নির্মাণের ক্ষেত্রে রিভার অ্যান্ড রেইন সম্পূর্ণ প্রকল্পের দায়িত্বই তাদের কাঁধে নেন।

প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি ৬-৭টি কন্টেইনার ব্যবহার করে বাড়ির নকশা করার পরিকল্পনা করেন। তবে সে জায়গার মাটির অবস্থা এতো বড় অবকাঠামোর জন্য উপযুক্ত ছিল না। তাই স্থপতিরা অবকাঠামোর নির্মাণের সুবিধা ও খরচের বিবেচনায় চারটি কন্টেইনার দিয়েই বাড়িটি নির্মাণের পরিকল্পনা সাজান।
স্থাপত্যবিদ্যার জগতে শিপিং কন্টেইনার দিয়ে বাড়ি বানানো নতুন কিছু নয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি বাড়িটিতে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মতো প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করায় বাড়ির সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়। বাড়িটির প্রাঙ্গনের দেয়ালগুলো বাঁশ ও বিভিন্ন ধরনের গাছ দিয়ে বানানো। সেইসাথে বাড়িটির সামনে আছে একটি লন, টেনিস কোর্ট ও পুরো প্রাঙ্গন জুড়ে সবুজের ছোঁয়া।
শহুরে বাড়িগুলোতে খোলা আকাশের দেখা পাওয়া দুষ্কর, এ বাড়িটিতে চাইলেই আকাশ দেখা যাবে। বাড়িটির প্রতিটি কক্ষে চলাচলের সময় আকাশ দেখা যাবে এমনভাবে বাড়িটি নির্মাণ করেছেন স্থপতিরা।
বেশিরভাগ কন্টেইনার বাড়িই শুধু কন্টেইনার দিয়ে নির্মাণ করা হয়। তবে এসকেপ ডেনের ক্ষেত্রে বাড়িটিতে অবস্থানের সময় ভাসমান অনুভূতি এনে দিতে লোহার পাতও ব্যবহার করা হয়। লোহার পাত দিয়ে প্রাথমিক অবকাঠামো নির্মাণ করে তার মধ্যে কন্টেইনার ঢুকিয়ে দেয়া হয়।
কন্টেইনার বাড়ির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই বাড়ির ভেতরের সাথে বাহিরের অঞ্চলের তেমন কোনো সংযোগ থাকে না। তবে এ বাড়িটির ক্ষেত্রে প্রচলিত কন্টেইনার বাড়ির কাঠামো থেকে বেরিয়ে বাড়ির ভেতরের সাথে বাহিরের সংযোগের ব্যবস্থাও রাখাও হয়েছে।
লোহার পাত থেকে শুরুর করে বাড়ির ভেতরের দরজা, বাড়িটি নির্মাণে ব্যবহৃত প্রায় সবকিছুই পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান। বাড়িটির মূল অবকাঠামো হিসেবে ব্যবহৃত পাত ঢালাইয়ের মাধ্যমে তৈরি হয়নি, বরঙ এক্ষেত্রে নাট-বল্টু ব্যবহার করা হয়।

প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বাদ দিতে স্থপতিরা কন্টেইনারগুলো রঙ না করে আগের অবস্থাতেই রেখে দেন। দুতলা এ ভবনের প্রতি তলায়ই নতুন চমক অপেক্ষা করছে। নিচতলায় রয়েছে রান্নাঘর, ডাইনিং এরিয়া ও লাউঞ্জ। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলেই গ্লাসে ঘেরা শোবার ঘর। আরও এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে সিলিং-এ সবুজে মোড়ানো দুটি শোবার ঘর।
মেঝে থেকে সিলিংয়েও গ্লাসের ব্যবহারের কারনে সহজেই ঘরের ভেতর আলো-বাতাস প্রবেশ করে। প্রাকৃতিক আলোর উপস্থিতি ঘরের পরিবেশকে আরও প্রাণবন্ত উজ্জ্বল করে তুলেছে।
বাড়িটির মালিকের প্রশংসা করে রিভার অ্যান্ড রেইন জানায়, তাদের ঐকান্তিক ইচ্ছার কারণেই তারা কংক্রিটে ঘেরা শহরেও অসাধারণ বাড়িটি তৈরির অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
"গ্রাহকরা সহায়তা করলে স্থপতিদের স্বপ্নের প্রকল্প বাস্তবে রূপ দেয়া আরও সহজ হয়," বলেন তারা।
কয়েক বছর আগেও বাড়িটি যে জায়গা নির্মিত সে জায়গাটি পানির নিচে ছিল, চারপাশে ছিল ঝোপঝাড়। বাড়ি নির্মাণের চার বছরের মধ্যেই বাড়িটি স্থাপত্যবিদ্যার আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

"আমরা জানি যে এধরনের বাড়িগুলো চিরকাল টিকে থাকে না। ভবিষ্যতে হয়তো এই জায়গাতেই বহুতল ভবন নির্মিত হতে পারে। তবে আপনার যে সময় আছে তাই কেন উপভোগ করবেন না?" প্রশ্ন রাখেন তারা।
এ প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িত স্থপতিরা হলেন কাজী ফিদা ইসলাম, মো আব্দুল আওয়াল, সুমাইয়া শামীম, মৌসুমি কবির এবং ইরতেফা ইরাদাত।